জোবাইর হোসাইন সিকদার
আমি মূলত দুই শহরের বাসিন্দা। এক শহর পূবে, আরেক শহর দুনিয়ার পশ্চিম প্রান্তে। পূব শহরে আমার জন্ম, শৈশব ও যৌবনের শুরু আর পশ্চিমের শহরে আমার বর্তমান। পূবের শহর আমার প্রিয় চট্টগ্রাম আর বর্তমান আমেরিকার ম্যাসাসুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টন শহর সংলগ্ন। এই দুই শহরের দারুণ মেলবন্ধন আছে। দুই শহরেই বন্দর আছে, নদী আছে, পাহাড় আছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে, আমার জন্ম শহরের পাহাড় বিলীন হচ্ছে। পুকুর-জলাশয় ভরাট হচ্ছে, নদী সাগর দখল-দূষণে বির্পযস্ত হচ্ছে প্রতিনয়ত আর পশ্চিমা শহরে পরম যত্নে প্রকৃতির এই শোভা প্রতি ঋতুতেই নব যৌবনে পেখম মেলছে।
এই দুই শহরের যাপিত জীবনের আলোকে আমি দেখেছি, প্রাণ প্রকৃতি রক্ষার জন্য আইন বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা যতটা না কার্যকর তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর সেই শহরের বাসিন্দাদের প্রকৃতিপ্রেমী হওয়া। পাহাড়-নদীর গান শুনতে পারার মতো কান তৈরি হওয়া। তা না হলে সে শহরের প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। যার করুণ চিত্র আজ শহর চট্টগ্রামের বির্বণ রূপ। অথচ এই শহরেই ষাটের দশকে প্রকৃতির রূপ লাবণ্যের প্রেমে তৈরি হয়েছিল একটি দ্বিতল সড়ক (টাইগার পাস সড়ক)। আজকের মতো এত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি বা দফতর প্রকৃতি প্রেম লালন করতেন বলেই সীমাবদ্ধতার মাঝেও গড়ে উঠেছিল এই অনন্য নির্দশন।
বর্তমানে আমি যে সড়ক দিয়ে প্রতিদিন কাজে যাই, তার অন্তত দু’জায়গায় প্রায়শ গাড়ি থমকে দাঁড়ায় লালবাতি ছাড়াই। কারণ এই দু’জায়গায় রাজহাঁস রাস্তা পার হয়। মজার ব্যাপার হলো এই রাজহাঁস কারো পোষা নয়, তাদের রাত-দিন কাটে লেক আর লেকের ধারের পার্কে। আবার চাইলেই কেউ তাদের তুলে নিতে পারে না জেল- জরিমানার ভয়ে। একইভাবে কারো মালিকানাধীন ভিটের গাছ চাইলেই মালিক নিজে কাটতে পারবেন না। তার জন্য সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে আবেদন করতে হবে, অনুমতি মিললেই তবে নিয়ম মেনে কাটতে হবে গাছ।
প্রকৃতি ও প্রাণীর প্রেমটা পশ্চিমারা মূলত স্কুল থেকেই পায়। খুব ছোট বয়স থেকেই তাদের ভেতর এই বীজ রোপিত হয়। কুকুর-বিড়াল তো পশ্চিমাদের ঘরে ঘরে। অনেকের কাছে সন্তান নেয়ার চেয়ে পশু পালনই শ্রেয়তর। তাদের এই পশুপ্রেমের কারণেই সুদীর্ঘ কাল ধরেই টিকে আছে এসব পশুখাদ্যের বিশাল ব্যবসায়িক বাজার। আমেরিকায় তাদের জন্যই রয়েছে পেটর্স্মাট (চবঃংসধৎঃ), পেটকো (চবৎপড়), পেটল্যান্ড (চবঃষধহফ), পেট সাপ্লাই প্লাস (চবঃ ঝঁঢ়ঢ়ষরবং চষঁং) সহ বেশ কয়েকটি চেইন সুপার স্টোর।
প্রকৃতি শোভার জন্যই চট্টগ্রামের পরিচিতি ছিল শ্যামল শহর বা ঠাণ্ডা শহর নামে। এই শহরে সবুজ দোল খেত। কৃষ্ণচুড়া আর সোনালুর রঙে রঙিন হতো এই শহর। যা এখন স্মৃতির পথে। সবুজ মাড়িয়ে এখন গাড়ি ছোটে দ্বিতল সড়কে। জলাবদ্ধতায় থমকে যায় শহরের গতি। অন্যদিকে পশ্চিমের এই বরফ ঝরা দেশে প্রকৃতির রূপ রক্ষায় রাষ্ট্রযন্ত্র কী বিশাল ধকলটাই না নিচ্ছে প্রতি বছর। এখানে চারটি ঋতুরই আলাদা অলাদা রূপ লাবণ্য অটুট থাকছে। প্রতি ঋতুতে ঋতু রূপের রূপেই রূপ নেয় মানব মনও। আমাদের পাশের নিউ হ্যাম্পশায়র অঙ্গরাজ্য মূলত প্রকৃতির রূপ বিকিয়েই টিকে আছে। প্রতিটি ঋতুতেই স্বকীয় শোভায় রূপ নেয় এই অঙ্গরাজ্য।
চট্টগ্রামের জোড়া দিঘি, ভেলুয়ার দিঘি, আগ্রাবাদ ঢেবা সহ সব জলাশয় দখল-দূষণের জাঁতাকলে আর পশ্চিমে লেক জলাশয় লালিত হয় পরম মমতায়। সম্প্রতি গত মে মাসে বোস্টনের পাশের শহর মালবোরো’র (গধৎষনড়ৎড়ঁময) লেক উইলিয়ামে তৈরি করা হয়েছে ৩ হাজার ফুট দৈর্ঘের ঋষড়ধঃরহম নড়ধৎফ ওয়াকওয়ে। প্রতিদিন শতশত দর্শনার্থী ভীড় করছে এই ওয়াকওয়ে দেখতে, ওয়াকওয়েতে
হাঁটতে। আমিও গিয়েছি পরিবার নিয়ে। হাঁটার সময় মনে হয়েছে যেন পা না ভিজিয়ে পানিতে হাঁটছি। মজার ব্যাপর হলো এত এত মানুষ আসছে, হাঁটছে। মুগ্ধ হয়ে ফিরছে। কিন্তু কেউ লেকের শ্রী হানি করছে না, হাতে পানি ছুঁয়ে দেখছে না, পদ যুগল পরিষ্কারে কেউ ব্যস্ত নয়। এসব সাবধান করার জন্য কোনো নিরাপত্তা কর্মীও নেই। প্রাকৃতিক ভাবেই মানুষগুলো যেন প্রকৃতির শিষ্যত্ব মেনে নিয়েছে। এমন প্রকৃতি প্রেমী মানুষ ছাড়া সত্যিই প্রকৃতি রক্ষা হবে না।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক
ছবি : লেখকের নিজের তোলা