অধ্যাপক অলক পাল
চট্টগ্রাম ভৌগোলিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাহাড়, সমুদ্র এবং উপত্যকায় ঘেরা চট্টগ্রাম শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রাচ্যের রাণী হিসেবে বিখ্যাত। প্রায় হাজার বছরের পুরোনো এই শহরটি ভাষা ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য ছাড়াও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জন্য দেশের অন্যান্য শহর থেকে আলাদা। পাহাড়, নদী ও সমুদ্র বেষ্টিত চট্টগ্রাম শহরকে ঘিরে আছে হাজার বছরের ইতিহাস এবং শহরটির সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত মানুষের ভাষা ও খাদ্যাভাস। এই সুপ্রাচীন বন্দর নগরীর ইতিহাসও বেশ বিস্তৃত। ভারতীয় সভ্যতার অমূল্য স্বাক্ষর মহাভারতের বিভিন্ন শ্লোকে চট্টগ্রামের আদিনাথ, চন্দ্রনাথ ইত্যাদি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। টলেমির তৈরি করা মানচিত্রেও চট্টগ্রাম শহরের বর্ণনা পাওয়া যায় প্রাচ্যের একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর নগরী হিসেবে। চট্টগ্রামের মানুষজন প্রাচীন সময় থেকেই বেশ সংস্কৃতিমনা। এই শহর ও শহরতলির প্রাকৃতিক দৃশ্য চট্টগ্রামের শিল্পীদের শিল্পকর্মের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এখানকার শিল্পের ধাঁচ অন্যান্য এলাকা থেকে ভিন্ন হওয়ায় চট্টগ্রামের শিল্পীরা বাংলাদেশের শিল্পজগতে তাঁদের স্বতন্ত্র পরিচয় প্রমাণ করেছেন। সংগীত চর্চায়ও এই শহর বরাবরই অনন্য। অনেক বিখ্যাত গান ও বিখ্যাত সংগীতশিল্পীর জন্মও এই শহরে। সোলস, এল.আর.বি সহ বেশ কিছু বিখ্যাত রক ব্যান্ডের শুরু এই শহরে হয়েছিল বলেই শহরটিকে “বাংলাদেশি রক সংগীতের জন্মস্থান”ও বলা হয়।
আজ থেকে প্রায় ২৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে ভারতীয় প্লেটের সঙ্গে ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বতমালার অংশ হিসেবেই চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল সৃষ্টি হয়। এই শহরের প্রায় ৬৭ শতাংশ এলাকা হলোসিন (ঐড়ষড়পবহব) সময়কালের পলি দ্বারা গঠিত। অন্যান্য শহরের তুলনায় চট্টগ্রামের ভূ-প্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এই মহানগরীর ভূমিরূপ গঠনের সঙ্গে ভূমি ব্যবহারের রয়েছে একটি নিবিড় সর্ম্পক। বিগত চার দশক জুড়ে চট্টগ্রামে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অপরিকল্পিত কাঠামোগত উন্নয়নের ফলে ভূ-প্রকৃতিগত পরিবর্তনের সঙ্গে ভূমি ব্যবহারের সম্পর্কের ছেদ পড়েছে। ভূমির গুনমান, মূল্য, নগর অর্থনীতির বিকাশ ও ভূমির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ও ভূমি ব্যবহারের ধরন প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। মূলত নগর সম্প্রসারণ ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। চট্টগ্রাম শহরের ভূমি ব্যবহার কাঠামো প্রচলিত নগর মডেলের কোনটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। উপযুক্ত ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার মাধ্যমে চট্টগ্রামে যথাযথ ভূমি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা দরকার। অন্যান্য শহরের তুলনায় কাজকর্মের সুযোগ বেশি থাকায় লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অবকাঠামোগত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়নি। এর ফলে আবাসন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রধান সমুদ্র বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, পোশাক শিল্পের প্রসার, সর্বোপরি বহুমুখী জীবিকার উৎস বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষকে চট্টগ্রামমুখী করেছে। এই
বাড়তি জনসংখ্যার সঙ্গে নগর বর্জ্যরে পরিমাণও বেড়ে চলেছে। যা নাগরিকদের সরাসরি স্বাস্থ্যগত ও পারিবেশিক সমস্যার জন্য দায়ী। শহরের কোলে গড়ে উঠেছে ইট ভাটা বা অন্যান্য কারখানা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকালয়, কিংবা নদীর তীরে বা পাহাড়ের পাদদেশে। এসব কারখানায় নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহার করায় প্রচুর পরিমাণ কালো ধোঁয়া নির্গমনের মাধ্যমে মানুষ ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে কর্ণফুলী ও হালদা নদীকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত নদী বিন্যাস গড়ে উঠেছে। ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করে কর্ণফুলী নদী। আর হালদা নদী কর্ণফুলী নদীর একটি উপনদী যা খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলা থেকে উৎপত্তি লাভ করে মোহরার নিকট কর্ণফুলী নদীতে মিলিত হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন কর্ণফুলী নদীর দূষণ ত্বরান্বিত করছে। তাছাড়া নদী ভরাট ও দখল কর্ণফুলীর স্বকীয়তা নষ্ট করার পিছনে ভূমিকা রাখছে যা চট্টগ্রাম শহর এবং তার সমুদ্র বন্দরের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশের শহরাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে নাগরিক সুযোগ সুবিধার (শিল্প-চিকিৎসা ইত্যাদি) চাহিদাও। বাংলাদেশের অন্যান্য বড় শহরের ন্যায় চট্টগ্রামেও দ্রুত বাড়ছে জনসমাগম, বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। সমানতালে প্রকট হচ্ছে নাগরিক সমস্যা সমূহও। দ্রুততম নগরায়নের দিক থেকে ২০১০ সালে বিশে^ চট্টগ্রাম মহানগরীর অবস্থান ছিল দশম। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো এর হিসাব অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহরের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৫,৮১,৬২৩। যদিও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তথ্যমতে চট্টগ্রাম নগরীর বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ। গবেষণা করে দেখা যায় শহরের সব এলাকাও স্বাস্থ্যসেবার দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার স্থানিক ঘনত্বের ভিন্নতা দেখে বোঝা যায় যে বর্তমান পরিকল্পনা যথেষ্ট নয় এবং তা কোনভাবেই বিদ্যমান অসমতা কমিয়ে আনতে সক্ষম নয়। সুতরাং এই সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ও ঘাটতি লাঘব করতে প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু এবং প্রায়োগিক পরিকল্পনা।
বাংলাদেশের শিল্পের দ্বিতীয় প্রধান পুঞ্জিভবন চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায়। প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ের ভৌগোলিক সুবিধা সুপ্রাচীন কাল থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীকে বিশে^র অন্যতম নৌবাণিজ্যের কেন্দ্রের পরিচিতি এনে দিয়েছে। তাছাড়া নদীপথে এই শহর দেশের অন্যান্য বাণিজ্যকেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত, সুদূর প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ব্যবসা- বাণিজ্য ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে যার পেছনে এই শহরের ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রুত নগরায়িত হচ্ছে। বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল এবং নিজ নিজ দেশের জিডিপিতে বড় অবদান রাখায় এসব শহরকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি বা শিল্প বিকাশের স্থানিক বিস্তরনের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় যে বড় ও প্রধান কয়েকটি নগর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে সিংহভাগ অবদান রাখছে যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকা। উৎপাদন শিল্প খাতসমূহ চট্টগ্রামের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। গড়ে উঠেছে লৌহ ও ইস্পাতের মতো ভারী শিল্প। বন্দরকেন্দ্রিক আমদানি-রপ্তানি সুবিধার আলোকে চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছে দেশের বৃহত্তম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ঊীঢ়ড়ৎঃ চৎড়পবংংরহম তড়হব) এবং বিকশিত হয়েছে তৈরি পোশাক, সিমেন্ট, সার কারখানা, তেল পরিশোধনাগার ইত্যাদি।
জাতীয় রাজস্ব আয়ের ৬০ শতাংশই আসে চট্টগ্রামের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদন থেকে। অনুকূল ভৌগোলিক সুবিধা থাকায় চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে জাহাজভাঙ্গা শিল্প। শহরের অদূরে সীতাকুণ্ডে বঙ্গোপসাগরের তীরে পরিচালিত হচ্ছে জাহাজভাঙ্গা শিল্প। সস্তা শ্রমের সহজলভ্যতা, লৌহ ও ইস্পাত শিল্প এবং দেশীয় জাহাজ নির্মাণশিল্পে কাঁচামাল হিসেবে জাহাজভাঙ্গা প্লেটের ব্যবহার, জাহাজের অন্যান্য যন্ত্রাংশ, পরিত্যক্ত তেল ও তেলজাত দ্রব্য, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ইত্যাদির বিপুল চাহিদা এই শিল্পকে দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পে পরিণত করেছে। তবে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও জাহাজভাঙ্গা শিল্প ব্যাপক মাত্রায় উপকূলীয় পরিবেশ দূষণকারী এবং শ্রমিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প হিসেবে সমালোচিত।
শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র নয়, চট্টগ্রাম বন্দর তথা গোটা চট্টগ্রাম হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। স্থলবেষ্টিত (খধহফ খড়পশবফ) নেপাল, ভূটান, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহ, মিয়ানমার ও চীনের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল তাদের আমদানী-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য তাকিয়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও সমন্বয়হীন উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগ যেমন পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতা মহানগরীর জীবনযাত্রার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডকেও ব্যাহত করে থাকে। তাই বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সম্প্রসারণে এর অন্যান্য ভৌগোলিক উপাদানসমূহকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনার নীতিমালা গ্রহণ করলে তবেই তা টেকসই হবে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা বিভাগকে সক্রিয়ভাবে নগর কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় সাধন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই ধরনের সমস্যাগুলো দ্রুতই কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়