শরীফ চৌহান
প্রকৃতির সব আশীর্বাদকে কিভাবে অভিশাপে পরিণত করতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে, চট্টগ্রাম। যে নদীতীরে শহরের গোড়াপত্তন ও প্রতিষ্ঠা সেই নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে । যে পাহাড় এই শহরের প্রাণ সেই পাহাড় কেটে শেষ করা হচ্ছে । যে সমুদ্রকে ঘিরে এর অর্থনীতি আবর্তিত হয় সেটাকেও দূষিত করা হয়েছে।
নদী, পাহাড় আর সাগর মেখলা চট্টগ্রাম – এখন ক্রমাগত এক মৃত নদীর এবং পাহাড়-শূন্য নগরীতে পরিণত হচ্ছে। এই বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় গত ৫৪ বছরে কোনো পরিকল্পনাই আমরা অনুসরণ করিনি।
আমরা জানি, শিল্পায়ন ও নগরায়ন হাত ধরাধরি করে চলে। একবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায়, যখন বাজার ব্যবস্থা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক তখন শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু উন্নত বিশ্বেও নতুন শিল্পায়নের আগে সংলগ্ন নগরের নগরায়ন পরিকল্পনাটি করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে আলাদা শিল্পনগরী তৈরি করা হয়।
কারণ, শিল্প স্থাপন প্রক্রিয়ার শুরুর আঘাতটি পড়ে স্থানীয় জনসাধারণ এবং পরিবেশের ওপর। মানুষ ও প্রকৃতি তার সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়। শিল্পায়ন কিছু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। কিন্তু সেই চাকরির খোঁজে থাকা জনগোষ্ঠীও অন্য কোন স্থানে শিল্পায়ন বা এরকম মনুষ্যসৃষ্ট কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আঘাতে উদ্বাস্তু মানুষ। তাই চাকরির খোঁজে আসা সর্বহারা এই জনগোষ্ঠীর বাসস্থান, যাতায়াত, চিকিৎসা, শিক্ষা ও খাদ্যের জোগানের জন্য শিল্পায়নের সাথে শহরটির পরিকল্পনাও খুব জরুরি।
এই প্রেক্ষাপটে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ খ্যাত বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দিকে যদি তাকাই, তাহলে কি দেখতে পাই? দেখা যায়, বন্দরকে ঘিরে সুদীর্ঘ কালের এই শহরের ইতিহাস থাকলেও এখানে পরিকল্পিত নগরায়নের কোনো দৃষ্টান্ত নেই। একসময় কর্ণফুলীর তীর ধরে শহর গড়ে উঠেছে। এর বাইরে শহরের তেমন একটা বিস্তৃতি ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর চট্টগ্রাম হয়েছে দেশের সকল আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র।
এখানে নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠেছে। রপ্তানিমুখ পোশাক শিল্পের গোড়াপত্তন এই চট্টগ্রামে। নির্মাণ খাতে কাঁচামাল সিমেন্ট ও ইস্পাত খাতের প্রায় সব কারখানাই এখানে৷ পাশাপাশি পুরাতন জাহাজ ভাঙা ও নতুন জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ, খাদ্য পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং শতভাগ রপ্তানিমুখী বহু শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে এখানে।
এসব কল কারখানার মধ্যে রপ্তানিমুখী বেশ কিছু কারখানা ইপিজেড গুলোতে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এর বাইরে কৃষি জমি, জনবসতি, বন উজাড় করে ও জলাভূমি দখল করে গড়ে ওঠা শিল্প শত শত। এমনকি বেশ কিছু খাতে শিল্প গড়ে ওঠার পর সেই খাতের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। যে কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা এবং সেখানকার পরিবেশ।
নীতিমালাই যদি না থাকে তাহলে শিল্প স্থাপনে পরিবেশের সুরক্ষায় কোন পদক্ষেপই যে নেয়া হয়নি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ন্যূনতম ইটিপিও অনেক কারখানা স্থাপন করা হয়নি। এসব ভারি শিল্পের দূষণের মাত্রা ভয়াবহ এবং তা দিন দিন বাড়ছে। এতে করে মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
শিল্প খাতের এমন নৈরাজ্যকর দশা থেকেই অনুভব করা যায় নগরায়নের পরিস্থিতি কি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, চট্টগ্রাম শহরে প্রথম ইপিজেড গড়ে উঠে দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরে। সেখানে হাজার হাজার কর্মীর জন্য আবাসন, চিকিৎসা ও তাদের সন্তানদের শিক্ষার কোন রকম ব্যবস্থা না করেই এই ইপিজেডের যাত্রা শুরু। এখানকার কর্মীরা আশপাশের এলাকায় অত্যন্ত মানবেতর ভাবে জীবন যাপন করছে। সেখানে জীবন ধারণের ব্যয় শহরের অন্য এলাকা থেকে অনেক বেশি। অথচ সেটা হওয়া উচিত ছিল উল্টো। চট্টগ্রামের সবচেয়ে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে ইপিজেড এলাকা।
গত তিন দশকে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের আয়তন বেড়েছে কয়েক গুণ। জনসংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পরিকল্পিত কোনো আবাসন নেই। গড়ে উঠেনি নতুন কোনো সরকারি স্কুল। নেই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। নেই আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। এমনকি ৭০ লাখ মানুষের বর্জ্য পরিশোধনেরও কোনো প্ল্যান্ট নেই।
শহরের সমস্ত আবর্জনা, পয়ঃবর্জ্য এবং শিল্প বর্জ্য নালা-খাল হয়ে কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ছে। নদীটি এখন মৃত। এই নদীতে এখন আর কোনো মাছ পাওয়া যায় না। শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়তে ১১ হাজার কোটি টাকার চারটা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি করছে সিডিএ। যেটি শুরু হয়েছে যথাযথ স্টাডি না করে, তড়িঘড়ি। ফলে এখনও নগরী প্রতিবার বৃষ্টিতে ডুবছে। নষ্ট হচ্ছে সম্পদ।
শহরের আয়তন বাড়ায় এবং শহর কেন্দ্রিক শিল্পায়ন হওয়ায় জীবিকার আশায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড়েছে এই শহরে। তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নগরীতে নির্বিচারে চলছে পাহাড় কাটা। পাহাড় ধসে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দখলের শুরুতে যে নিম্ন আয়ের মানুষদের সেখানে বসানো হয় কয়েক বছর পর তাদের সরিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয় বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি। তারপর আবার নতুন পাহাড় কাটা হয় গরিব মানুষের বসবাসের উছিলা করে। এই প্রাণঘাতী চক্রের শেষ নেই।
এই হলো চট্টগ্রামের নগরায়ন ও শিল্পায়নের পরিস্থিতি। এ থেকে উত্তরণের পথ এখন অনেক কঠিন। তবে এখনো সময় আছে। নতুন শিল্পায়ন যেমন বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরসহ অন্য শিল্প খাতগুলো যদি শহরের বাইরে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা যায় এবং সেখানে শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আবাসন, যাতায়াত, চিকিৎসা ও শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা যায় তাহলে মানুষ ও পরিবেশ দুই-ই বাঁচবে। আর তা না হলে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের অমোঘ পরিণতিতে চট্টগ্রাম নগরী প্রাকৃতিকভাবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হবে তা নয়, মানুষের জন্য বিষাক্ত নগরীতে পরিণত হবে।
সকলের এখনই সচেতন ও উদ্যোগী হওয়া উচিত।