মিন্টু চৌধুরী
বর্ষা এলে প্রতিবছরই বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো থেকে অবৈধ বসতিকারীদের সরানোর তোড়জোড় চলে। প্রশাসন বড় বড় মিটিং করে, তালিকা করে কোন পাহাড়ে কত পরিবার বা কত লোক ঝুঁকি নিয়ে বাস করছে। মাইকিং করে সরে যেতে বলা, সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো থেকে নেয়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগসহ লোক দেখানো হম্বিতম্বি করার মধ্যেই প্রশাসন তাদের বর্ষাকালীন দায়িত্ব সারেন।
বর্ষা শেষ, আবহাওয়া অফিসের ভূমি বা পাহাড় ধসের সতকর্তা শেষ। তারপর পাহাড়গুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির অবস্থা দাঁড়ায় আগের মতই। অথচ প্রতি বছরই চট্টগ্রাম মহানগরসহ অত্র অঞ্চলে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে মানুষের মৃত্যু থেমে নেই।
২০০৭ সালের ১১ জুন টানা বর্ষণের পর পাহাড় ও ভূমিধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির বিষয়টি প্রথম সামনে আসে, নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। চট্টগ্রামের স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা তদন্ত এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় নির্ধারণে পৃথক কমিটি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি।
ওই সময়ে গঠিত কমিটির তদন্তে চট্টগ্রামে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন পাহাড়েই অবৈধ বসবাসকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি থাকার বিষয়টি উঠে আসে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তাদের মালিকানাধীন পাহাড় থেকে অবৈধ বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া বা উচ্ছেদের কথা বলার ১৭ বছর পার হলেও অবস্থা আগের মতই। পাহাড়ে বসতিকারীদের মৃত্যু ঝুঁকি থেকে রক্ষার দায় যেন কারোরই নেই।
কিছুদিন আগে বর্ষা মৌসুম শুরুর সময়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি মিটিং করে জানায় চট্টগ্রাম মহানগরে ২৬টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৬৫৫৮টি। পাহাড়গুলোর মধ্যে ১৬টির মালিকানা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বাকি ১০টির মালিক ব্যক্তি পর্যায়ে। এর মধ্যে রেলওয়ের মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়েই ৪৯০১টি পরিবার অবৈধভাবে বাস করছে। এছাড়া গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দুটি, গণর্পূত বিভাগের একটি, আমিন জুট মিলের একটি এবং সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত চারটি পাহাড়ে অবৈধ বসতি রয়েছে। এসব পাহাড়ের অবৈধ বসতিতে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগও রয়েছে।
পাহাড়ে বসতিকারীদের তালিকা প্রতিবছর হালনাগাদের কথা বললেও ২০২৩ সালের হিসাবেও একই পরিমাণ পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে বলে উল্লেখ আছে। প্রশ্ন হলো প্রশাসন এই এক বছরে পাহাড় রক্ষা এবং বসতিস্থাপন নিয়ে কি করেছে?
ওই সময়ে সেসব পাহাড়ে অবৈধ পানি বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কতটুকু হয়েছে তার তথ্যও প্রশাসনের কাছে নেই। কেন নেই বা কেন হচ্ছে না এ বিষয়ে কোন জবাবদিহিতা সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মেলে না। সঠিক জবাব না মেলার পর আবারও নতুন করে উচ্ছেদসহ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নতুন করে নির্দেশনা দেয়া হয়।
দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়গুলোতে অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় প্রভাবশালী, সংশ্লিষ্ট পাহাড় মালিক প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে স্থাপনা তৈরি করে থাকতে দেয়া, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লোভ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ায় ঝুঁকি সত্ত্বেও পাহাড়গুলোতে অবৈধ বসবাস ঠেকানো যায় না।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে কথা বললে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের উচ্ছেদে তাঁরা তাদের অসহায়ত্বের কথা বলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা জনপ্রতিনিধিদের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায় সারেন। একদিকে প্রশাসন নিজেরা সব করে ফেলবেন এমন পরিস্থিতি দেখিয়ে পাহাড়ে অবৈধ বসতি নিয়ে দায়সারা ভূমিকা রেখে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ করছেন। অপরদিকে রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাঁদের ভোটের সমীকরণ মেলানো এবং পেশী শক্তির সমর্থনের জন্য পাহাড়ে বৈধভাবে বসবাসকারীদের ব্যবহার করছেন।
কিন্তু অবৈধভাবে বসবাস করা এসব নিম্ন আয়ের মানুষ বর্ষায় পাহাড় ধসে মারা গেলে তাঁদের কারোরই যেন কোন দায় নেই!