সকলের এখনই সচেতন ও উদ্যোগী হওয়া উচিত।

পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের বন্ধন

প্রণব বল

পরিবেশ ও স্বাস্থ্য শব্দ দুটি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন বা দূরের মনে হতে পারে। আসলে কি তা? স্বাস্থ্য মূলত ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর পরিবেশের ব্যাপ্তি অনেক বড়। একটা এলাকা, অঞ্চল, দেশ বা বিশ্বের বায়ু, পানি, গাছপালা, পশু পাখি, চন্দ্র সূর্য ইত্যাদির সন্নিবেশই পরিবেশ। আবার এই পরিবেশেরই একটা অপরিহার্য অংশ মানুষ। সে কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের মধ্যে একটা যোগসূত্র বিদ্যমান।

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষই পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্ন করেছে যুগে যুগে। আবার পরিবেশগত যাবতীয় ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাবের ফলও ভোগ করেন সেই মানুষ। সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীকূলকেও এই পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির বোঝা বয়ে চলতে হয়। চোখের সামনেই এমন ঘটনা ঘটছে। চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি খুঁজে দেখতে পারি আমরা।

২০০৯-১০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের  পরিচালক ছিলেন মো. আবদুস সোবাহান। পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে অবসরে যাওয়া এই ব্যক্তি এখন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন (পরিজা) নামে একটি সংগঠনের সভাপতি। সেবার পরিবেশ দিবসের আগে পরিবেশ পরিচালকের চেয়ারে বসে কয়েকজন      গণমাধ্যমকর্মীকে আবদুস সোবাহান বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ভালো নেই।’ এর স্বপক্ষে তিনি চট্টগ্রামের পানি, বাতাস ও শব্দ দূষণ এবং পাহাড় কাটার নানা দিক তুলে ধরেছিলেন। এক দশক পর এসেও চট্টগ্রামের  স্বাস্থ্যের উন্নতি তো হয়নি বরং দিন দিন রুগ্ন হয়েছে।

চট্টগ্রাম পাহাড়, সমুদ্র ও নদী ঘেরা একটা অঞ্চল। একসময়কার জঙ্গলাকীর্ণ প্রকৃতি প্রদত্ত অঞ্চলটিতে বসতি শুরু হয় সবুজ ও পাহাড় ধ্বংস করেই। বিভিন্ন গবেষণা ও ইতিহাস পর্যালোচনায় এখানে পাহাড় ধ্বংসের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬০ সালে প্রথম চট্টগ্রামে আবাসনের জন্য পাহাড় কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করে। ১৮৭২ সালে চট্টগ্রামে জনসংখ্যা ছিল  মাত্র ১৮ হাজার ৭৮০ জন। এরপর বন্দরকে ঘিরে শহরের আকার বাড়তে থাকে। ১৯০১ সালে চট্টগ্রাম শহরের ব্যাপ্তি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ বর্গকিলোমিটার। তখন জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার।

১৯৪৭ সালে জনসংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৪ হাজার। দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে শিল্পায়নের জন্য ষোলশহর, নাসিরাবাদ, পাহাড়তলী ও ফৌজদারহাট এলাকায় পাহাড়ে কোপ পড়ে। এর দশ বছর পর থেকে সরকারি বাংলো তৈরি এবং পাহাড় কিনে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ শুরু হয়। স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সাল থেকে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা ব্যাপকভাবে বাড়ে। শুরু হয় পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা নির্মাণ।

১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম শহরের পরিধি ছিল ১৫৬ বর্গকিলোমিটার, যার ৭৮ বর্গকিলোমিটারই পাহাড়। তখন জনসংখ্যা ছিল ২৩ লাখের বেশি। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। বাড়তি এই জনগোষ্ঠীর চাপে চিড়েচ্যাপ্টা পাহাড়।

এখনো প্রতিদিন কান পাতলেই শোনা যায় পাহাড়ের কান্না। পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ চলছেই। আর প্রতিবছর পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। পরিবেশ বিধ্বংসী নেতিবাচক প্রভাবের ফলে এই প্রাণহানি। মানুষের প্রাণের চেয়ে বড় স্বাস্থ্যগত সমস্যা আর কি হতে পারে।

আবার কাটা পাহাড়ের মাটিতে ভরাট হচ্ছে খাল নালা নর্দমা। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন, মারা যায় ১২৭ জন। ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পর এটাকে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পরিবেশ বিপর্যয় হিসেবে ধরা হয়। এরপরও থামানো যায়নি পাহাড় ও বনাঞ্চল উজাড়।

চট্টগ্রামের ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙামাটিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ধসে মৃত্যু হয় ১৬৮ জনের। রাঙামাটিতেও পাহাড়কে বিরক্ত করা হয়েছে নানাভাবে। সেই বিরক্তির বহিঃপ্রকাশকে অনেকে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাহাড় ও সবুজ কমার সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা যেমন বেড়েছে তেমনি প্রাণিকূলও হারিয়েছে তাদের বাসস্থান। আমরা যেখানে উত্তর প্রজন্মের কথাই ভাবছি না, সেখানে পশু-পাখি তো অনেক দূরের কথা।

এবার পানি, বায়ু ও শব্দজনিত প্রভাবটি দেখা যাক। নগরায়নের কারণে বেড়েছে কলকারখানা, যানবাহন। এই বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কিন্তু একই কারণে যে নগরের স্বাস্থ্যের ১২টা বাজছে সে খবর ক’জন রাখছে। নগরের বাতাস, পানি ও শব্দের সহনীয় মাত্রা যে প্রতি মুহূর্তে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এসব সহনীয় মাত্রার মধ্যে রাখার কার্যকর উদ্যোগের বড়ই অভাব।

পরিবেশ অধিদপ্তর নগরের ৩০টি স্থানে নিয়মিত শব্দের মান পরীক্ষা করে। কিন্তু গত দু মাসে কোথাও তা সহনীয় মাত্রার মধ্যে পাওয়া যায়নি। তার মানে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা-কোনো স্থানই আর নিরব নেই। শব্দে অস্থির মনুষ্য ও     প্রাণিকুল। হাইড্রোলিক হর্নের যথেচ্ছ ব্যবহার, জেনারেটর, যত্রতত্র মাইক বাজানো এবং নির্মাণকাজের শব্দে এই দূষণ হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৭ সালে আটটি বিভাগীয় শব্দের মাত্রা পরিমাপবিষয়ক এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, চট্টগ্রামে ৯৫ ভাগ শব্দদূষণের মূল উৎস গাড়ির হর্ন। এরপর অন্যান্য কারণ রয়েছে।

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ ও ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থা কি সেভাবে নেওয়া হচ্ছে?

এই শব্দের নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের।  চমেক হাসপাতালের নাক, কান, গলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক পংকজ চৌধুরীর ভাবনাটা এ রকম। তিনি বলছেন, প্রতিনিয়ত কানে কম শোনা রোগী পাচ্ছি। তাদের ইতিহাস জানার সময় বুঝতে পারি শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ার আসল কারণ। মূলত গাড়ির হর্ন ও কারখানার শব্দে বেশি মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

বায়ু দূষণের জন্যও দায়ী সেই কারখানা, সেই     যানবাহন, উন্নয়ন ও অপরিকল্পিত নির্মাণ কর্মকাণ্ড। ঢাকার পর চট্টগ্রামের বাতাসের মানমাত্রা সবচেয়ে খারাপ থাকে। বায়ু দূষণজনিত স্বাস্থ্যহানিও ঘটছে। এ নিয়ে নানা সময় আওয়াজ ওঠে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামে যত শ্বাসতন্ত্র প্রদাহের রোগী রয়েছে তার বড় একটি অংশ বায়ু দূষণের কারণেই।

পানি দূষণের সবচেয়ে কাছের নজির হচ্ছে দু মাস আগে এস আলমের চিনিকলে আগুন পরবর্তী কর্ণফুলী দূষণ। এই দূষণের পর নদীর মাছ মরে ভেসে উঠেছে। এতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির আশঙ্কাও করেছেন গবেষকেরা। এ ছাড়া নিয়মিত গৃহস্থালির বর্জ্যে নদী দূষণতো ঘটছেই। আর সুপেয় পানির উৎস এবং প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীও এখন দূষণের কবলে। এসবের প্রভাবই আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।

তাই পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের বন্ধন যতদিন নিবিড় অন্তরতর বা বন্ধুত্বপূর্ণ করা না যাবে ততদিন এই ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে। পরিবেশের বিপর্যয় মানেই স্বাস্থ্যের ক্ষতি। এই বোধ যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এসবের মধ্যেই চলতে হবে আমাদের।

লেখক : সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে