গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাব দেখার সবচেয়ে ভালো জায়গা হিমালয়

বাবর আলী (চট্টগ্রামের প্রথম এভারেস্ট জয়ী)

দুই দিনের ব্যবধানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট এবং চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোৎসে আরোহন করা প্রথম বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। হালদা পাড়ের গ্রাম থেকে হিমালয় শীর্ষে পৌঁছানোর এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। তবে এখানেই থামতে চান না বীর চট্টলার সন্তান বাবর আলী। তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য আট হাজার মিটার উচ্চতার আরও শৃঙ্গ জয় করা। বাবর আলী মনে করেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাব দেখার সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো হিমালয়।

বাবর আলী বলেন, “আমরা হিমালয়ের ছায়ায় বসবাস করি আসলে। হিমালয়ের দানই বলতে পারি আমাদের বাংলাদেশকে। আমাদের যে বৃহৎ         নদীগুলো- পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রসহ অনেক নদী হিমালয়ের নানা গ্লেসিয়ার (হিমবাহ) থেকে আসা। এসব নদী হয়ে আসা পলি জমেই তো আমাদের ব-দ্বীপটির সৃষ্টি।  সে-হিসেবে আমাদের দেশ থেকে হিমালয়ে তেমন একটা অভিযানই হয় না। গ্লোবাল ওয়ার্মিং (বৈশ্বিক উষ্ণায়ন) এর প্রভাব দেখতে হলে সবচেয়ে ভালে জায়গা হিমালয়। কিভাবে গ্লেসিয়ার রিট্রিট (হিমবাহ সরে যাওয়া) ও গ্লেসিয়ার লেক সৃষ্টি হচ্ছে, এগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে ভালো জায়গা হিমালয়।”

বাংলাদেশের অন্য সব পর্বতারোহীর মতোই বাবর আলীর শুরুটাও ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার পাহাড়গুলোতে ট্র্যাকিং করে। সেই অভিজ্ঞতা জানিয়ে বাবর আলী বলেন, “২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত সেখানে প্রচুর ট্র্যাকিং করি। যেহেতু আমাদের এই স্পোর্টসে ঝুঁকি আছে, তাই যখন শুরু করি তখন পরিবার থেকে একটু বাধা পেতাম। পরে যখন দেখে, ভালো কাজ করছি তখন আর সেভাবে বাধা আসেনি।”

এর আগে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০২২ সালে আরোহন করেছিলেন আমা দাবালাম। লোৎসে আরোহণেও তিনি বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রথম। আট হাজার মিটার উচ্চতার দুটি পর্বত শৃঙ্গ আরোহণ করলেন, এভারেস্ট আর লোৎসে কোনটি বেশি আনন্দ দিয়েছে?

উত্তরে বাবর আলী বলেন, “আমরা যারা পর্বতারোহণ করি, আমাদের সবার স্বপ্ন থাকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ থেকে নিচের পৃথিবীকে দেখা। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাই আমি খুব খুশি। তবে বেশি খুশি হয়েছি লোৎসে সামিট করে। কারণ সেটা টেকনিক্যালি খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। আর নতুন চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে আমি সবসময় পছন্দ করি। তাই লোৎসে আমাকে খুব বেশি আনন্দ দিয়েছে।”

এর আগে আরো পাঁচজন বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেছেন। কিন্তু তাঁরা এভারেস্ট জয় করেই থেমেছিলেন। এরপর আবার লোৎসে কেন? কেন এই পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি? বাবর আলী সেই পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বলেন, “২০২২ সালে যখন আমা দাবালাম সামিট করি তারপর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করতো, এভারেস্টে কখন যাচ্ছি। তখন থেকেই এভারেস্ট সামিটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। নিজেকে যাতে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা যায়, নতুন কিছু করা যায় সে চিন্তা করছিলাম। ২০২৩ সালেই এভারেস্ট সামিট করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু সেসময় পড়ালেখার জন্য কিছু সময় দিতে হয়। তাই ২০২৩ মিস করি আমি। তখনই মাথায় আসে দুটো একসাথে করব। আগে বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন এভারেস্ট সামিট করেছেন। কিন্তু কেউ একসাথে লোৎসে সামিট করেননি। তাই ভাবি সেটাই করব।”

২০১০ সাল থেকে পাহাড়ে চড়া শুরু চট্টগ্রামের হাটহাজারীর সন্তান বাবর আলীর। ১৪ বছরের মাথায় জয় করলেন এভারেস্ট চূড়া। এভারেস্ট জয়ের পর পরিবারের সবাই খুব খুশি হলেও এখনো বাবা-মা আর ভাই-বোনরা বাবরকে নিয়ে চিন্তায় থাকেন, কারণ পর্বতারোহণে আছে মৃত্যুঝুঁকি।

ঝুঁকির কথা যখন উঠলই তখন জেনে নেয়া যাক এভারেস্ট ও লোৎসের পথে কোনো বিপদের মুখে পড়েছিলেন কিনা? উত্তরে বাবর আলী যখন বরফ শীতল কণ্ঠে আড়াই ঘণ্টার তুষার ঝড়ের কথা বলেন, তখন মনে হয় আসলেই অন্য ধাতুতে গড়া বীর চট্টলার এই  সন্তান। পর্বতারোহী মাত্রই জানেন তুষার ঝড় কতটা ভয়াবহ হতে পারে। আর দীর্ঘসময় ধরে চলা তুষার ঝড় হতে পারে মৃত্যুর কারণও। কিন্তু বাবর আলীর কাছে এই ঝড় শুধু বিলম্বের একটা কারণ মাত্র।

তাই বাবর আলী খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে চলেন, “আমার প্রস্তুতি বেশ ভালো ছিল। বেশি বড় ঝুঁকির মুখে পড়িনি। তবে এভারেস্ট থেকে নামার সময় তুষার ঝড়ে পড়ি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা আটকে ছিলাম। বাকি সবই ঠিক ছিল। আর বেশ ঠাণ্ডা তো ছিলই। সেখানে এটাই প্রত্যাশিত। ১৯ মে এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছার পর ২০মে আমার লোৎসে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই তুষার ঝড়ের কারণে সময় নষ্ট হয়। আর বিকেলে আবহাওয়া আরো খারাপ হয়ে যায়। সেখানে বিকেলের দিকে আবহাওয়া খারাপই থাকে। এ কারণে আর সেদিন রওনা হইনি। পরদিন লোৎসের উদ্দেশে যাত্রা করি।”

বাবর আলীর এভারেস্ট জয়ের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসার পাশাপাশি নানা সমালোচনাও শুরু হয়। দেশ থেকে একাধিক পর্বতারোহীর এভারেস্ট যাত্রা, সেখানকার পরিবেশ দূষণ ও ব্যয়বহুল এভারেস্ট অভিযান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এমন সব                আলোচনা-সমালোচনা তাঁকে টলাতে পারেনি একটুও।

অনাবিল হাসিতে এই বিতর্ক এড়িয়ে বরং তরুণদের          পর্বতারোহণে আগ্রহী হবার আহ্বান জানান বাবর আলী। তিনি বলেন, “ফুটবল-ক্রিকেটের মতোই দলগত খেলার পাশাপাশি ইন্ডিভিজুয়াল স্পোর্টসেও আমরা এখন খুব ভালো করছি। ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে যদি মাত্র ৪০-৫০ জন সিরিয়াসলি মাউন্টেনিয়ারিং করে, এটা অপ্রত্যাশিতভাবে কম। আশা করি তরুণরা এ ধরণের স্পোর্টসে এগিয়ে আসবে, যেখানে ব্যক্তিগত দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ আছে। তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই দারুণ সব এচিভমেন্ট হবে।”

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বুড়িশ্চর এলাকার লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগম এর দ্বিতীয় সন্তান বাবর ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১ তম ব্যাচের ছাত্র। কিছুদিন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করলেও আগের অভিযানের সময় ছুটি না মেলাতে ত্যাগ করেন চাকরির মোহ। তবে এবার নিজ পেশায় ফিরতে চান তিনি। বাবর আলী বলেন, “আগে আমি চাকরিই করতাম। যেহেতু জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমার পড়াশোনা তাই চাকরিতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করি।”

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও এবং জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থার হয়ে কাজ করা বাবর আলী অবশ্য এবার নিজ এলাকায় প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতে চান। এর কারণ জানিয়ে বাবর আলী বলেন, “আমি আগে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করিনি। কিন্তু বাবা-মার চাওয়া আমি এটা করি। এবং সেটা নিজ এলাকায়। এবার সেটা করব।”

আর পাহাড় চড়ার স্বপ্ন? দুটি আট হাজারি ও একটি ছয় হাজারি চূড়া আরোহণকারী বাবরের লক্ষ্য যে আরো অনেক বড়। তাই পরের  লক্ষ্যও মনে মনে ঠিক করে ফেলা বাবর আলী বলেন, “পৃথিবীতে আট হাজারি পর্বত আছে মোট ১৪টি। সবগুলো হয়তো সম্ভব না। তবে আরো কয়েকটা সামিট করতে চাই। আগামী বছরই একটা সামিট করব।” সেই শৃঙ্গ কোনটি তা অবশ্য বলেননি বাবর। সেখানেও হয়তো কোন রেকর্ড গড়ে আবার সবাইকে আনন্দে ভাসাতে চান বাবর আলী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে