সারা বছরই ডেঙ্গু হচ্ছে এবং হবে

ডা. মামুনুর রশিদ

বাংলাদেশে বিগত ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ধরা পড়ে এবং প্রতিবছরই আউটব্রেক চোখে পড়ছে। প্রথম দিকে এটি বছরে সাধারণত মে-জুন মাস থেকে শুরু হয়ে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত দেখা দিলেও বিগত দুই থেকে তিন বছর ধরে এটি বছরব্যাপী আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি জেলায় দেখা দিচ্ছে।

২০২৩ সালে আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়, যা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। সর্বোচ্চ মৃত্যুও হয় ১৭০৫ জনের। আর ২০১৯ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন রোগী ছিল, এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। আর ২০২৩ সালে মোট রোগীর ৫২ শতাংশ ঢাকার বাইরের জেলা থেকে। বাকি ৪৮ শতাংশ এসেছিল ঢাকা থেকে। ২০২৩ সালে পুরুষ এবং মহিলা যে শতকরা তা হলো ৩/২। এর বেশির ভাগ কেস পাওয়া  গেছিল ১৯ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে।

মূল কথা হলো, ডেঙ্গু কিন্তু মোটামুটি এন্ডামিক হয়ে গেছে আমাদের দেশে। আমাদের দেশে এডিস মশার দুইটা প্রজাতি আছে। একটা হলো এডিস ইজিপ্ট। আরেকটা হলো এডিস এলবোপিটাস। এদের কামড়ের মধ্য দিয়ে মূলত মানুষের শরীরে  ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে এবং এদেরকে ভেক্টর বলা হয়। আমাদের দেশে যদিও ডেন ওয়ান, ডেন টু, ডেন থ্রি, ডেন  ফোর এ চারটি রকম পাওয়া গেছে ডেঙ্গু ভাইরাসের। কিন্তু বিশে^র অনেক দেশে ডেন-ফাইভ পাওয়া গেছে। আমাদের দেশে  ডেন-ফাইভ আছে কি না তা গবেষণা করে দেখা দরকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন সারাবছর এ ডেঙ্গু আমাদের দেশে পাওয়া যাচ্ছে। এর মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন।

আমাদের দেশে জলবায়ুর বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে প্রচণ্ড হিট এলার্ম পরিলক্ষিত হয়েছে এবং হিট স্ট্রোকে অনেক মানুষ মারাও গিয়েছে। এগুলোর কারণে যেটা হচ্ছে- ইরেগুলার রেইন ফল। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়া, বায়ুর আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়া- এ দুটো বড় ফ্যাক্টর। যার কারণে বাতাসে আগের থেকে পেড়ে থাকা, হু (ডঐঙ) বলছে, একটা এডিস মসকিটো বাতাসে যে ডিম পেড়ে রাখে, যা এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত ভায়বল থাকে। তিন বছরের মধ্যেও যদি ওই ডিমের সংস্পর্শে বৃষ্টি আসে তাহলে ওই ডিম থেকে পিউপা হয়ে লার্ভা হতে মাত্র ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে। তার মানে আমাদের ইরেগুলার রেইনফল যখনই হবে তখনই আগে থেকে মশকের ডিমগুলো, সেগুলো  ফুটে নতুন নতুন এডিস মশা হবে এবং এ এডিস মশা সারাবছর আমাদের দেশে থাকবে, ও থাকছে। যেহেতু সারাবছরই এডিস মশা থাকছে, সেহেতু সারাবছরই ডেঙ্গু হচ্ছে এবং হবে।

এখন আরেকটা প্রশ্ন আসে। সিভিয়ার ডেঙ্গু কখন হয়। সিভিয়ার ডেঙ্গু হতে গেলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর আছে। যদি কোনো সিজনে- দুইটা বা তিনটা অথবা চারটি স্ট্রেনথ আউটব্রেক হয় তাহলে সে বছর সিভিয়ার ডেঙ্গুর সংখ্যা বাড়বে। আর সাধারণত কোনো ব্যক্তি প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সিভিয়ার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় না। যদি না তারমধ্যে বিভিন্ন উপসর্গ না থাকে।

কিন্তু একই ব্যক্তি  যদি দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থবার আক্রান্ত হয় তাহলে তার মারাত্মক ডেঙ্গু হয়, মৃত্যু হওয়ার হারও বাড়ে। আমাদের দেশে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দুটো টেস্ট এনএস১, আইসিএমএন আইসিস ডেঙ্গু। মনে রাখতে হবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জ¦রের হিস্ট্রিটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গুর জ¦রতো কোনদিন থেকে কোন সময় তার হিস্ট্রি লিখতে হবে। মনে রাখতে হবে জ¦রের ৫ম দিন এনএস১। তারপরে আইসিএমএন আইসিস টেস্ট করতে হবে। আপনি যদি জ¦রের আগে আইসিআইজিএম করেন তাহলে নেগেটিভ আসবে। যদিও রোগী ডেঙ্গু পজেটিভ। আর পাঁচদিন পর যদি এনএস১ করেন তাহলেও নেগেটিভ আসবে।

বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী তিন ধরনের চিকিৎসা অনুসরণ করি। একটা গ্রুপ এ, আরেকটা বি, পরেরটা সি। গ্রুপ এ রোগী যারা তাদের ওয়ার্নিং সাইট নেই, শুধু এনএস১ ও আইসিজি পজেটিভ। গ্রুপ এ রোগীদের প্যারাসিটাম্যাল ও তরল খাবার দিতে হবে, ওরস্যালাইনও দিতে হবে। তবে ফলোআপ করতে হবে কোনো ওয়ার্নি সাইট বিয়ার করতো কি না।

গ্রুপ বি হচ্ছে যে ডেঙ্গু রোগীর একটা ওয়ার্নিং সাইট ও কোনো মরমেটিভ আছে। গ্রুপ সি হলো – যেসব রোগীর সিভিয়ার ব্লিডিং অথবা প্লাজমা লিকেজ অথবা সিভিয়ার অরগান ইনভলবমেন্ট হয়ে গেছে। এই গ্রুপ বি ও সি পেশেন্টকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।

ওয়ার্নিং সাইটগুলো সবার মুখস্ত রাখতে হবে। জানতে হবে। এসব কন্ডিশন জনগণেরও জানতে হবে। এগুলো যদি কারও শরীরে ডেভলপ করে তাহলে সরাসরি ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ডেঙ্গু রোগীর যদি সার্বক্ষণিক বমি ও পেট ব্যথা হয়, প্রচণ্ড দুর্বলতা ও অস্থিরতা কাজ করে, শরীরে রক্তক্ষরণ হয়, মাথা ঘোরা ও শরীর যদি ঠাণ্ডা হয়ে যায়, প্রস্রাব যদি ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে না হয়, কমে যায়, লিভার বড় হয়ে যায়,     হেমাটোলের বেস লাইন যদি বেড়ে যায় এগুলো হলো ওয়ার্নিং সাইট। কারও যদি হার্ট ফেউলিউর থাকে, অন্তঃস্বত্তা কি না, ডায়াবেটিস থাকলে, লিভার ফেইল থাকলে এটি কো-মরটিভ। ডেঙ্গু রোগীর প্রথম ট্রিটমেন্ট হলো গ্রুপিং করে ফেলা। কোন রোগীকে বাসায় রাখব, কোন রোগীকে হাসপাতালে নিব এটা গ্রুপিং করতে হবে। সব রোগীকে যদি হাসপাতালে দিই তাহলে হাসপাতালের বেড সংকট হবে। গ্রুপ এ-এর রোগীদের বাসায় রেখে এবং গ্রুপ বি ও সি-এর রোগীদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করতে হবে। সঠিক সময়, সঠিকভাবে সঠিক ফ্লুয়িড এডমিনস্ট্রেশন করতে পারাই ডেঙ্গু চিকিৎসার মূলমন্ত্র। ম্যাক্সিমাম ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর কারণ হলো ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে না দেওয়া। রোগীর ফ্লুয়িড সঠিক সময়ে প্রয়োগ না করা। ডেঙ্গু রক্তনালিকার রোগ, এটাকে প্লাজমা লিকেজ রোগ বলা হয়। ডেঙ্গু  রোগ হলে রক্তনালিকার উপাদানের মধ্যে পরিবর্তন হয়। রক্তনালিকার মধ্য থেকে যে প্লাজমা আছে, সেগুলো বের হয়ে আসে। যার ফলে হাইপো টেনশন ও শকে চলে যায়।

এটার কারণে সেকেন্ডারি কিছু প্লাটিলেট কমে। কিন্তু প্লাাটিলেট ডিরেক্ট লিক হবে না। যার কারণে প্লাটিলেট ট্রান্সমিশন ফোবিয়া প্রতিবছর দেখা দেয়। প্লাটিলেট সাধারণত আমরা দেখেছি- গত ২৩ বছর যাবত আমরা এসব রোগীর চিকিৎসা করছি। প্লাটিলেট ৫ হাজার ও ১০ হাজারের নিচে না নামলে সাধারণত প্লাটিলেট দিয়ে লাভ হয় না। দরকারও নেই। বরং লেনসেটের একটি স্টাডিতে দেখা গেছে প্লাটিলেট যদি অযাচিতভাবে

দেওয়া হয় তাহলে ব্লিডিং বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ রক্ত নালিকার পরিবর্তন হয়ে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।

আবার ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাল ইনফেকশন সেহেতু এর এন্টিবায়োটিক কোনো রুল নাই। এটা মনে রাখতে হবে। টাইফয়েড, নিউমোনিয়া থাকলে সেক্ষেত্রে শুধু     এন্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে। ডেঙ্গু রোগীকে অযাচিত এন্টিবায়োটিক দেওয়া হলে বিপদ। রোগীর               চিকিৎসাকালীন সময়ে এথেসথিস দেওয়া অন্যায়। ব্লাড ট্রান্সমিশন শুধু রোগীর যদি সিরিয়াস ব্লিডিং হয় হেমারেজ হয় তখনই রেসপিক্ট ফিজিশিয়ানের সিদ্ধান্ত মতে দেওয়া হবে। আর ফ্লুইড এপ্রোপিয়েট ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুযায়ী ফলো করে করতে হবে। রোগীকে রাইস টিউব ও ক্যাথেটার করা যাবে। একেবারে প্রয়োজন না হলে এসব করা যাবে না। কারণ এসবে ব্লিডিং হতে পারে।

পেঁপে পাতার রস নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। পেঁপে পাতায় ডেঙ্গু চিকিৎসা হয় না, রোগী ভালো হওয়ার এমন কোনো প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিছু কিছু রোগী ইমিউনিটি বর্ধক ওষুধ খান বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ার ওষুধ খান। এগুলোর কোনো সায়েন্টিফিক বেসিস নাই। আমাদের চেষ্টা করতে হবে ডেঙ্গু যাতে প্রিভেন্ট করতে পারি। হয়ে গেলে চিকিৎসা করতে হবে। এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করতে হবে।     যতরকমের পদ্ধতি আছে সব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে সামগ্রিকভাবে আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করতে পারব।

বাসায় দিনের বেলায় ও রাতের বেলায় প্রতিরোধমূলক মশারি, এরোসল ও ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। জানালার মধ্যে নেট দিতে পারি। ক্লিনিং ও জমে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। আর ইনস্টিটিউশন লেভেলে হাসপাতালের রোগীদের মশা যাতে না কামড়ায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া আমাদের লার্ভার উৎসস্থলগুলো ক্লিনিং করতে হবে। তিনদিনের বেশি যাতে পানি জমা না থাকো সে ব্যবস্থা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সকলের সচেতন হতে হবে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় ব্যক্তি, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দেশের জনসাধারণ একসঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়লে অন্যান্য দেশের মতো সফলতা আসবে।

  লেখক : অধ্যাপক, ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে