উন্নয়ন বনাম পরিবেশ ও প্রকৃতি এবং আমাদের দায়িত্ববানেরা

কামরুল হাসান বাদল

প্রাক্কথন

উন্নয়নের সঙ্গে প্রকৃতির বিরোধ শুরু থেকেই। অর্থাৎ যেদিন থেকে সনাতন অবস্থা থেকে মানুষ উত্তরণের চেষ্টা করেছে সেদিন  থেকে প্রকৃতির ক্ষতি হওয়া শুরু হয়েছে। যেহেতু প্রাণিদের মধ্যে মানুষ বুদ্ধিমান সেহেতু মানুষ দিনদিন তার অবস্থা ও অবস্থান বদলাতে চেয়েছে। বন-জঙ্গল কেটে আবাদি জমি সৃষ্টি করেছে। সে জমিতে আবার বাড়িঘর, দোকানপাট তৈরি করেছে। তারপর একসময় শিল্পযুগ এসেছে। এভাবে মানুষ আধুনিক থেকে আধুনিক হয়েছে আর অন্যদিকে প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

একসময় মানুষ অনুধাবন করেছে প্রকৃতিকে বিনষ্ট করে মানুষ ভালো থাকতে পারে না। ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশ ঠিক রেখে কিভাবে উন্নয়ন করা যায় তা ভেবেছে। তবে ততদিনে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। মানুষ প্রকৃতি  রক্ষার উদ্যোগ যখন নিয়েছে তার আগেই অনেক  ক্ষতি হয়ে গেছে যার অধিকাংশই পূরণীয় নয়।

যাক তারপরও বলা হয়, ‘লেট বেটার দ্যান নেভার’ একদম না হওয়ার চেয়ে বিলম্বও ভালো।

প্রকৃতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে শিল্পোন্নত দেশগুলো। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে তার দায় বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত       দেশগুলোকে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে প্রথমে। ফলে আমাদের ঝুঁকিটা বেশি। কাজেই আমাদের সকল পরিকল্পনায় পরিবেশ ও প্রকৃতির গুরুত্ব অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটি। দেশের সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার পরিবেশের ক্ষতি না করে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বললেও সেটা কার্যকর হয় না। বরং ঘটে তার উল্টোটি। সাম্প্রতিক

কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরলে পাঠকদের সুবিধা হবে।

১। কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উজানে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানের একটি চর। ১৯৩০ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে          কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কারণে ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানে এই দ্বীপ জেগে ওঠে। চরটির আয়তন প্রায় ১০৫ একর। বর্তমানে চরটি সরকারি এক নম্বর খাস খতিয়ানে নদী শ্রেণির জমি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই চরটিতে বর্জ্য শোধনাগার করার জন্য ২০২৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনুকূলে খাসজমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত প্রদানের একটি আবেদন ভূমি মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হয়। বর্তমানে চরটিতে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প স্থাপনের জন্য মাটি পরীক্ষার কাজ চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন।

এরপরের ঘটনা আরও সাংঘাতিক। এবার সিটি করপোরেশন সিদ্ধান্ত নেয়, সে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের। এবং সেটা এই নদীর মাঝখানেই।

বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গত এক যুগে একাধিক বিদেশি সংস্থা থেকে ২০টি প্রস্তাব পায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। প্রস্তাবনাগুলো পর্যালোচনার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায় চসিক। এর মধ্যে চীনের প্রতিষ্ঠান সেভিয়া-চেক- অর্চাড জেভির একটি প্রস্তাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চর বাকলিয়ায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্ল্যান্ট বসাতে চায়। মন্ত্রণালয় চাইনিজ প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবটিতে আগ্রহ দেখায়। পরবর্তী সময়ে প্ল্যান্ট বসাতে চর বাকলিয়ায় ৩৫ একর খাস জমি বন্দোবস্তের জন্য চসিককে প্রশাসনিক অনুমোদনও দেয়। খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়া গেলে তা সেভিয়া-চেক- অর্চাড জেভির ব্যবহারে আপত্তি নেই বলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়ে দিয়েছে চসিক।

বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইকো) ২০২২ সালে তাদের একটি গবেষণায় চর বাকলিয়ার          উদ্ভিদবৈচিত্র্য তুলে ধরে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে সেই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় চর বাকলিয়ায় মোট ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করে। যার মধ্যে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ, ২০ প্রজাতির বিরুৎ, ৫৭ প্রজাতির গুল্ম, ১২ প্রজাতির লতানো উদ্ভিদ ও পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সংখ্যা ছিল ২টি। ১৫৫টি উদ্ভিদের ভিতর ১১৩টি ঔষধি গাছ বিদ্যমান। চরে গাছপালার মধ্যে পাহাড়ি শিমুল, বেগুনি হুরহুরি, প্রাজাসেন্ট্রা, হরগোজা, ভূঁই উকড়া, ঝুমকোলতা, আকন্দ, স্বর্ণলতা, ঘাগড়া, শিয়াল কাঁটা, শিরীষসহ নানা প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। এছাড়া দেশীয় আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ নানা রকমের ফলদ গাছও আছে। এগুলো ধ্বংস করে এখানে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় সিটি করপোরেশন।

২। স্বাধীনতার পর গত পঞ্চাশ বছরে চট্টগ্রাম নগরের মানচিত্র থেকে কত খাল গায়েব হয়ে গেছে তার হিসাব খোদ সিটি করপোরেশনেও নেই। দখলে-দূষণে হারিয়ে গেছে অনেক খাল। ভরাট হয়ে গেছে অর্ধশতাধিক খাল। সেগুলো এখনো রক্ষা করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। তারমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন খাল খননের। চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন একটি খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া

হয়েছিল অন্তত দশ বছর আগে। চট্টগ্রাম নগরের বারইপাড়া এলাকা থেকে শুরু হয়ে নূর নগর হাউজিং, ওয়াইজ পাড়া হয়ে বলির হাটের পাশ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশবে নতুন খাল। নতুন এ খালের দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিলোমিটার। চওড়া ৬৫ ফুট। ২০১৪ সালের জুনে ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় খালের খননকাজ শেষ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। যদিও একই খালের কাজ উদ্বোধন করা হয়েছে দুবার। শুধু তাই নয়। দুই দফা প্রকল্প সংশোধনের পর ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

৩। নগরের বায়েজিদ থানাধীন নাগিন পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকা। ১৯৯৭ সাল থেকে পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি টের পায় ২০২১ সালে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নাগিন পাহাড়ের দূরত্ব মাত্র তিন থেকে চার কিলোমিটার হলেও পাহাড় কাটার সংবাদ পেতে তাদের সময় লেগেছে ২৪ বছর। এরপর ২৯টি ভবন এবং প্লটের মালিককে জরিমানা এবং ৯ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে। সেই মামলাটির অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। বর্তমানে আবাসিক এলাকাটিতে কমপক্ষে ৫০টি প্লট রয়েছে। এতে বেশির ভাগ প্লটে নির্মিত হয়েছে ভবন।

শুধু নাগিন পাহাড় নয়, গত চার দশকে চট্টগ্রামের ১২০টি পাহাড় বিলীন হয়ে গেছে বলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছে পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম।

বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের পক্ষে বলা হয়েছে, ১৯৭৬ সালে বন্দর নগরীতে পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গ কিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৪.০২ বর্গ কিলোমিটারে। তাঁরা দাবি করেন, ৪০ বছর আগে বন্দর নগরীতে ২০০ পাহাড় ছিল। কিন্তু, এখন পাহাড়ের ৬০ শতাংশ এলাকা ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বায়েজিদ সংযোগ সড়ক নির্মাণের কারণে ১৫টি পাহাড় কেটে ফেলেছে।

লিখিত বক্তব্যে দাবি করা হয়, সলিমপুর পাহাড়ের আয়তন ৩ হাজার ১০০ একর। কিন্তু, গত দুই দশকে এসব পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন সেই পাহাড়গুলোতে হাজার হাজার বাড়ি তৈরি হয়েছে।

৪। দোকানসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের কারণে চট্টগ্রাম নগরের বিপ্লব উদ্যানের সবুজ ও উন্মুক্ত পরিসরের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছিল। এ অবস্থায় আবারও উদ্যানটিতে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এ জন্য ভরাট করা হয়েছে পানির ফোয়ারা। ভেঙে ফেলা হয়েছে গ্লাস টাওয়ারও। এ নির্মাণকাজ করতে গিয়ে উদ্যানে প্রবেশের মূল পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বড় বড় ব্যানার টানিয়ে উদ্যানের চারপাশ ঘেরাও করা হয়েছে। নগরের দুই নম্বর গেটে অবস্থিত উদ্যানটিতে কোনো ধরণের স্থাপনা নির্মাণ না করার এবং পুরোনো স্থাপনা অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিল নাগরিক সমাজ, নগর-পরিকল্পনাবিদ ও বিভিন্ন সংগঠন। ‘সবুজ ধ্বংস করে নতুন স্থাপনা আর নয়’ লেখা একটি ব্যানার টানানো হয়েছে উদ্যানে। নগরবাসীর পক্ষ থেকে এ ব্যানার লাগানো হয়েছে।

কিন্তু সবার আপত্তি উপেক্ষা করে উদ্যানে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণে অনড় চট্টগ্রাম সিটি   করপোরেশন। ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম দুই নম্বর গেটে গাছগাছালিতে ভরা দুই একরের এই উদ্যান গড়ে তোলা হয়। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি কংক্রিট অবকাঠামো থাকতে পারবে না। আর আন্তর্জাতিকভাবে ২ শতাংশও অনুমোদন করে না। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানের কংক্রিট অবকাঠামোর পরিমাণ অন্তত ৫৫ শতাংশ।

৫।  সিডিএ চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ প্রায় শেষ করেছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৪ নভেম্বর ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র‌্যাম্প (গাড়ি ওঠা-নামার পথ) রয়েছে। এর মধ্যে টাইগারপাসে রয়েছে দুটি। একটি দিয়ে গাড়ি উঠবে এবং আরেকটি দিয়ে নামবে। গাড়ি ওঠার র‌্যাম্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী অংশ

দিয়ে। আর এই র‌্যাম্প নির্মাণ করতে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হলেও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। কাটার জন্য গাছ চিহ্নিত করে নাম্বার দেওয়া হয়েছে।

৬। এর আগে সিআরবিতে একটি বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়  চট্টগ্রামের আপামর জনগণ।  চট্টগ্রামের ফুসফুস বলে খ্যাত সিআরবি চত্বর, বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক স্থান। এত সুন্দর স্থান গোটা বিশ্বেও খুব বেশি নেই। চট্টগ্রাম নগরে খোলা জায়গা খুব বেশি নেই। ডিসি হিল ছিল তা এখন অবরুদ্ধ। সাধারণ মানুষ সেখানে ঢুকতে পারেন না। সেখানে অসাধারণরা থাকেন। ডিসি হিল ছিল চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীদের প্রাণের জায়গা। তা এখন ধূসর অতীত।  এরপর নগরবাসী সকাল-সন্ধ্যা এই খোলা চত্বরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসেন কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার আশায়। সংস্কৃতিকর্মীরা পহেলা বৈশাখ, বসন্ত উৎসবের মতো বছরে দুতিনটি অনুষ্ঠান করতে পারতো। নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এটি নগরবাসীর বড় প্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে।  এখানে আছে সোন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং বা সিআরবি, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শত বছর আগে ব্রিটিশ আমলে। আসাম-বেঙ্গল রেলের মূল কার্যালয় ছিল এটি। এই ভবন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। ভবনের আশপাশে আছে রেলওয়েম্যানদের সরকারি বাসভবন।

আসলে হাসপাতাল বলতে আমরা বুঝি একটি আলিশান বিল্ডিং, তার ভেতর সারি সারি বেড, বেডের ওপর নাকেমুখে নল লাগিয়ে রাখা রোগী। কিন্তু প্রকৃতি যে একটি বিশাল হাসপাতাল সে কথা আমরা থোড়াই মনে রাখি। এই সিআরবিতে সকাল-সন্ধ্যায় হাঁটতে আসেন শত শত হার্টের রোগী, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও নানা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা। এখানে এসে তাঁরা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখেন, ফুসফুস ভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করেন। কেউ অবসর সময় কাটাতে পরিবার পরিজন নিয়ে আসেন। অনেকে খেলাধুলা করতে আসেন। আর নানা উৎসবে এখানে এসে মনের পিপাসা মেটান। মোট কথা অনেকভাবে এই সিআরবি নগরবাসীকে সুস্থ রাখতে, আনন্দ ও জীবনমুখী করে রাখতে অবদান রাখছে। প্রকৃতির এই বিশাল হাসপাতালকে ধ্বংস করে ইট-পাথরের কোনো হাসপাতাল এখানে চায়নি চাটগাঁবাসী।

৭। গাছ নিয়ে কিছু তথ্য পাঠকদের দিতে চাই।

একটি গাছ বছরে ১১৮ কেজি অক্সিজেন বাতাসে ছাড়ে। বাতাস থেকে শোষণ করে ২৩ কেজি     কার্বনডাই-অক্সাইড। একটি গাছ দুজন মানুষের অক্সিজেন জোগায়। সে গাছের দাম কত হবে? সম্প্রতি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে জমা করা শেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ৭৪,৫০০ রুপি দিয়ে গুণ করা হবে গাছের বয়স। গাছের নতুন দাম হিসেবে সেই অঙ্কই ধার্য করা হবে। পাশাপাশি একটি গাইডলাইনের কথাও উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে।

ভারতের প্রধান বিচারপতি (সিজেআই) এস এ ববদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের বেঞ্চ এই রিপোর্ট জমা করেছে, যে কমিটি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গাছের   অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছিল, গাছ যে পরিমাণ অক্সিজেন ছাড়ে, তার ভিত্তিতে চলে গোটা জগৎ। কাজেই একটা গাছের মূল্যকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।

পাঁচ সদস্যের কমিটি এই রিপোর্টে বলা আছে, হ্যারিটেজ ট্রি বা যে গাছের বয়স ১০০ পার হয়েছে, সেই গাছের দাম হবে  কোটি টাকার বেশি। কিছু  ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, কোনও প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একের পর এক গাছ কাটা হয়। তার দাম ধার্য করা হয় না সেভাবে। ফলে পরিবেশের সম্পদ ভারতের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে না।

৮। ১৭৩০ সাল। ভারতের রাজস্থানের প্রত্যন্ত অঞ্চল খেজারিলি গ্রামে একটি রাজপ্রাসাদ গড়ার পরিকল্পনা করলেন তৎকালীন  মেওয়ারের রাজা অভয় সিং। তার নির্দেশে শুরু হয় গাছ কাটা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিন সন্তানের জননী অমৃতা দেবী।  সে সময় তার সাথে যোগ দেয় গ্রামের বিষ্ণু সম্প্রদায়ের লোকেরাও। তাঁদের উদ্দেশ্য, যে করেই হোক গ্রামের গাছগুলোকে বাঁচাতে হবে। আর সেজন্য গাছের সাথে নিজেদের জড়িয়ে রেখে শুরু হয় গাছরক্ষা আন্দোলন। আর এভাবেই গাছকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থাতেই রাজার সৈন্যদের হাতে তাঁরা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন।

সে ঘটনার অনেক বছর পরে ভারতেই আরেকটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। চিপকো নামের সে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল গত শতকের সাত দশকে ভারতের উত্তর প্রদেশে। সে সময় এলাহাবাদের করাতকল মালিকদের ইচ্ছেমতো গাছ কাটার অনুমতি  দেয় সরকার। কিন্তু বাধ সাধে ‘মহিলা মঙ্গল দল’ ও তার প্রধান গৌরা দেবী। ২৫ মার্চ ১৯৭৫ সালে  করাতকলের লোকজন গাছ কাটতে এলে খবর পেয়ে ছুটে আসেন তিনি। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরও বেশ কিছু নারী। তাঁরা গাছ কাটা ঠেকাতে জীবনবাজি রেখে গাছকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ‘জড়িয়ে ধরা’ বা ‘সেঁটে থাকা’-কে হিন্দিতে বলে চিপকো, আর এই শব্দ থেকে নাম হয়েছে চিপকো আন্দোলন।

সেদিন তাঁদের নিরস্ত করতে না পেরে গুলি করার হুমকি দেয় কর্তৃপক্ষের লোকেরা। কিন্তু গৌরা দেবীরা ছেড়ে দেননি, গাছটিকে জড়িয়ে ধরে সারা রাত জেগেছিলেন। পরের দিন আবারও করাতকলের লোকজন এলে গাছ কাটার খবর আশপাশের   

গ্রামগুলোতেও ছড়াতে শুরু করে। দলে দলে লোকজন ছুটে আসে গাছরক্ষা আন্দোলনে যোগ দিতে। চার দিন পর করাতকলের লোকজন পিছু হটতে বাধ্য হয়। বিজয়ী হন গৌরা দেবীর দল।

পরে এই আন্দোলনের সাফল্য ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়ে পুরো উত্তর প্রদেশে। রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খবর গেলে, তিনি বিষয়টি অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। তার ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর নেওয়া সিদ্ধান্ত আন্দোলনকারীদের পক্ষেই গিয়েছিল। ১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পুরো হিমালয় অঞ্চলে পনের বছরের জন্য সব ধরনের গাছ কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

৯। থাইল্যান্ডের এক বৌদ্ধ ভিক্ষুও বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে অভিনব এক আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। ফ্রাক্রু পিতাক নানথাখুন নামে এই ভিক্ষু গত ২৫ বছর ধরে পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে গাছপালার গায়ে পরিয়ে দিচ্ছেন গেরুয়া পোশাক।

কোন মানুষের গায়ে গেরুয়া উঠলে যেমন সে ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে। তেমনি আমরা যখন কোন গাছের গায়ে  গেরুয়া চড়াই তখন আশা করি মানুষ সেটিকে একটি পবিত্র চিহ্ন হিসেবে দেখবে এবং গাছটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে।’ থাইল্যান্ড বৌদ্ধ-প্রধান দেশ। বৌদ্ধ ধর্মমতে এই গেরুয়া পোশাককে পবিত্র বলে মনে করা হয়। তাই গাছের গায়ে গেরুয়া  পোশাকের জন্য কেউ আর গাছটি কেটে ফেলতে চায় না। ফ্রাক্রু পিতাক নানথাখুন বলছেন, ‘থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নান্ প্রদেশে

বনভূমি ধ্বংসের মাত্রা এখন এক বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মধ্যস্বত্বভোগী দালাল, ভূমিদস্যু এবং অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাপক হারে গাছপালা কেটে ফেলছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম কিভাবে একে  মোকাবেলা করা যায়। শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক পুস্তক ঘাঁটাঘাটি করে এর জবাব পেলাম।’

এই প্রথায় ধর্মীয় আচার পালনের পর গাছের গায়ে ছিটিয়ে দেয়া হয় পবিত্র জল এবং পরিয়ে দেয়া হয় গেরুয়া। এইভাবে  গেরুয়া পোশাক পরিয়ে নান প্রদেশে বহু গাছকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। প্রকল্পটি এতটাই সফল যে লাওস,    ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ভুটান এবং শ্রীলংকাতেও একইভাবে গাছ রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়েছে।

সাধারণত মানুষ বিনষ্ট করে প্রকৃতিকে আর সরকার প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর জন্য আইন প্রণয়ন করে, আইন প্রয়োগ করে। বর্তমানে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সরকার স্বয়ং পরিবেশ ও ঐতিহ্য বিনষ্ট করছে আর সাধারণ মানুষ তা রক্ষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করছে।

কী দুর্ভাগ্য!

১০। রাজা তার আবহাওয়া বিভাগের প্রধানকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি মৎস্য শিকারে যেতে চাই, আজকের আবহাওয়া কেমন থাকবে বলে জানা গেছে?’

সে বলল, ‘আজকে অতীব সুন্দর, রৌদ্রোজ্জ্বল এবং চমৎকার আবহাওয়া থাকবে জাঁহাপনা, আপনি নিঃশঙ্ক চিত্তে যেতে পারেন।’

রাজা বের হলেন। যখন তিনি সাগর পাড়ে গেলেন তখন সেখানে এক জেলে ছাগল চড়াচ্ছিলো, সে বললো, ‘মহারাজ আজকে কেন আপনি সাগরে  যাচ্ছেন ? একটু পরেই তো প্রচণ্ড বৃষ্টি হবে।’

রাজা রেগে বললেন,  ‘বেটা জেলের বাচ্চা! তুই কী জানিস আবহাওয়ার খবর? আর আমাকে কি মূর্খ পেয়েছিস!  আমি খবর  জেনে তবেই এসেছি।’

রাজা সাগরে গেলেন, কিছুক্ষণ পর শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়বাদল।

রাজা প্রাসাদে ফিরে এসে আবহাওয়া বিভাগের প্রধানকে বরখাস্ত করলেন, তার স্থলে ওই জেলেকে ধরে এনে আবহাওয়া বিভাগের প্রধান বানিয়ে দিলেন। এ অবস্থায় জেলে পড়ে গেলেন মহা ফাঁপড়ে। সে তো আবহাওয়ার কিছুই জানে না। একদিন রাজার কাছে গিয়ে জেলে কেঁদে-টেঁদে বলল, ‘মহারাজ আমাকে যেতে দিন!  আমি আসলে আবহাওয়ার কিছুই জানি না।

রাজা বললেন, ‘তাহলে ওই দিন আমার আবহাওয়া বিভাগের চেয়েও সঠিক খবর তুই কী করে দিলি?’

জেলে বলল, ’‘মহারাজ সেখানে আমার কোনো কৃতিত্ব ছিল না! সব কৃতিত্ব আমার ছাগলের! বৃষ্টি আসার আধাঘণ্টা আগে  থেকে ছাগলটা ঘনঘন

পেচ্ছাপ করে! তা থেকে আমি বুঝতে পারি একটু পর বৃষ্টি হবে।’

তারপর রাজা জেলেকে ছেড়ে দিয়ে তার ছাগলটাকে ধরে এনে আবহাওয়া বিভাগের প্রধান বানিয়ে দিলেন। এটা স্রেফ গল্প। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।

১১। সিটি করপোরেশনের কাজ হলো নাগরিকদের সেবা দেওয়া। নালা-খাল পরিষ্কার রাখা। নগরকে সুন্দর ও বাসযোগ্য রাখা। সিডিএ-র কাজ হলো একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলা। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ হলো পরিবেশ রক্ষা করা তথা পরিবেশ পাহারা দেওয়া। আর ওপরে যে  অনিয়মগুলো তুলে ধরলাম সবকটির সঙ্গে জড়িত এই তিনটি প্রতিষ্ঠান।

১২।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক, সেটা পরিবেশবান্ধব হতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। সেই লক্ষ্য রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে খরচের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। শনিবার (১১ মে, ২০২৪) রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) ৬১তম কনভেনশনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

যেকোন প্রকল্প গ্রহণের আগে দেশ ও মানুষের কাজে লাগবে কিনা এবং সেটি লাভজনক হবে কিনা তা বিবেচনায় নিতে প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকল্প থেকে জনগণ কি পাবে এবং তা থেকে রিটার্ন কি হবে- এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু নির্মাণের জন্য নির্মাণ করা যাবে না। আমি সংসদে সবাইকে সেটি বলেছি। তা না হলে  কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হবে না।

প্রকৌশলীদের গবেষণায় জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কৃষি যান্ত্রিকতায় আরো এগিয়ে যেতে প্রকৗশলীদের যে উদ্ভাবনী শক্তি, মেধা     আছে- সেটা কীভাবে দেশের কাজে লাগাতে পারি তাতে নজর দিতে হবে। খাদ্যপণ্য সংরক্ষণে গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যা উৎপাদন হচ্ছে তা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করে দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানির দিকে নজর দিতে হবে। সেই লক্ষ্য রেখে আমাদের গবেষণা ও পরিকল্পনা দরকার।’

সরকারের লক্ষ্য তৃণমূল থেকে উন্নয়ন করা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘তৃণমূলের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, মাথাপিছু আয় বাড়ানো, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব সেই পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। সব চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে পারব। সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর একেবারে সাম্প্রতিক বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি পাঠকদের বোঝাতে যে, আমি শুরুতে যা বলেছিলাম তা সঠিক বলেছি কিনা।

 লেখক : কবি ও সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে