বানরের পথ অবরোধ

ওমর কায়সার

১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাস। একটা সাংগঠনিক কাজে এক বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রবর্তক বিদ্যাপীঠে। কাজ শেষে দুই  বন্ধু মিলে পাহাড়ে ঢালুপথের সিঁড়িতে বসে কথা      বলছিলাম। এমন সময় হঠাৎ সামনে আবির্ভূত হলো একটা বানর। অনেকটা গেরিলার মতো। মনে হচ্ছিল চারপাশের ঘন গাছপালার আড়াল থেকে এতক্ষণ সেটি আমাদের অনুসরণ করছিল। এখন বাগে পেয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করতে এলো। সময়টা মধ্যাহ্ন। তবুও শীতল। রোদের উৎপীড়ন নেই। প্রবর্তকের আরণ্যক পরিবেশে এখানকার মাটিকে অসূর্যস্পর্শা করে রেখেছে বড় বড় গাছের ডালপালা, পত্রপল্লব। শান্ত, নির্জন গা ছমছম করা একটা আমেজ। সেই সময় আমাদের সামনে মুখটাকে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো বানিয়ে বোবা বানরটি যেন জিজ্ঞেস করছে, কিরে তোদের এখানে কাজ কি?

আমরা দুজন ভড়কে গেলাম। ভয়ে উঠে দাঁড়াতেই বানরটি সচকিত হয়ে উঠল। ভাবটা এমন- খবরদার যেতে পারবি না। ওকে এড়িয়ে পাশ কেটে যেতে চাইলাম। কিন্তু না, আমরা যেদিকেই পা বাড়াই সেদিকেই ও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অগত্যা সামনের দিকে এগোবার চেষ্টা না করে পেছনে ফিরলাম। ফিরেই অবাক হলাম। পেছনে এতক্ষণ আরেকটি বানর সবকিছু অবলোকন করছিল। তার মানে আমরা বন্দী। অবরুদ্ধ। সামনে পেছনে দুই বানরের অবরোধে অসহায়ের মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকার সেই মধুর তিক্ততার কথা ইদানিং প্রায় মনে পড়ে। দুই যুগ পেরিয়ে এসে এখন আমাকে পেশাগত কারণে প্রতিদিন প্রবর্তক এলাকায় আসতে হয়। আর প্রতিদিন দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ থাকি। আমাকে অবরোধ করে রাখে হাজার হাজার যানবাহন। যে জায়গায় তখন জানা অজানা শত শত গাছপালার ভেতর থেকে বানর বেরিয়ে আসতো, সেই জায়গায় এখন  শত শত দালান থেকে বেরিয়ে আসছে গাড়ি।

বানরের সেই পথ অবরোধের কাহিনিটি আজ বড় প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে কারণ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন  এলাকায় জীববৈচিত্র্য এখন প্রায় শূন্যের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে কী পরিমাণ    গাছপালা, পশুপাখি রয়েছে তার কোনও হিসাব- নিকাশ কারও কাছে নেই। সেই হিসাব বের করতে এবং সেগুলো রক্ষার তাগিদ থেকে এই সিটি করপোরেশন একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। এই উদ্যোগের খবর যঁাঁদের চোখে পড়েছে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খুশি হওয়ার পাশাপাশি অতীতাকূল হয়েছেন। কেন না প্রবর্তকের বানরের স্মৃতির মতো বহু ঘটনার কথা এই নগরের পুরোনো বাসিন্দার মনের মধ্যে গাঁথা আছে। মনে পড়ে সদরঘাটে কর্ণফুলী নদীর তীরে ব্র্র্র্রিজঘাটায় বট গাছে শত শত বানরের লাফালাফি দাপাদাপির কথা। শুধু বানর নয়, এই চট্টগ্রামের জীব বৈচিত্র্যের তালিকায় বাঘও ছিল। পথের পাশ দিয়ে বাঘ হেঁটে যেতো বলে ইংরেজরা একটি এলাকার নাম দিয়েছে টাইগার পাস। এ কোনো গল্প নয়, ইতিহাস। আমাদের দূর বা নিকট অতীতের দিকে তাকালেই বুঝব ঘন সবুজ এক আরণ্যক পরিবেশে পাহাড়ের ভেতরেই বেড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম নগর। সেজন্যেই হয়তো ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে চৈনিক লেখক ওয়াং তা ইউয়ান তাঁর বই তাও  রিচি লিয়েতে  চট্টগ্রামের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই এখানকার ‘উচ্চ ও শিলাবন্ধুর পর্বতমালার’ কথা উল্লেখ করেছেন। এর পাঁচশ বছর পর ইংরেজ আমলে চট্টগ্রামে কালেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন  এ এল ক্লে সাহেব। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ফ্রম এ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গলে পাহাড়ি চট্টগ্রাম শহরের বর্ণনা পাওয়া যায়, ‘নিম্নবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা চাঁটগা। নিচু টিলা,  চূড়োয় বাড়ি, পাকদণ্ডী বেয়ে উঠতে হয়। কোনো কোনো পাহাড়ে চমৎকার সব দৃশ্য চোখে পড়ে। দূরে দিগন্তে কর্ণফুলী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে, চারপাশে ছড়ানো ছিটানো পাহাড়ের চূড়োয় বিন্দুর মতো সাদা বাংলো, মাঝে মাঝে বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে মন্দির বা মসজিদ। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে তাকালে চোখে পড়ে সরব রাস্তা, উপত্যকা।’

প্রাচীন জমিদার বংশের নিঃস্ব সন্তান তার পূর্বপুরুষের প্রতাপ নিয়ে গর্ব করে আর নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে যেমন মাতম করে আমাদের চট্টগ্রামবাসীর অবস্থাও এখন সেরকম। চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকাননে আমাদের বাড়ি। এখানে ডিসি পাহাড়কে ঘিরে দশ-বারো বছর আগেও যে জীব আর উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ছিল তাও পাওয়া যায় না। দুবছর আগেও এখানে রাতে শেয়ালের ডাক শুনতাম। এখন আর শোনা যায় না। ডিসি পাহাড়ের শিরিষ গাছে ছিল অগুনতি টিয়ে পাখির বাসা। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়ে পাখি নন্দনকাননের নীল আকাশটি ছেয়ে ফেলত তাদের সবুজ ডানায়। টিয়ে ছাড়াও এই ডিসি পাহাড়ে কত রকমের পাখি দেখেছি। দেখেছি সজারু, সাপ, শামুক। ডিসি পাহাড়ের পলাশ, শিমুল এখনো বসন্তের রং ছড়িয়ে দেয় নগরবাসীর মনে। তবে এই পলাশ শিমুল কিংবা মে মাসের আগুন জ্বালানো কৃষ্ণচূড়াও একদিন তাদের প্রতিবেশী টিয়ার ঝাঁকের মতো হারিয়ে যাবে। কারণ এদের বেঁচে থাকার জন্য অনুকূল পরিবেশ আমরা রাখতে পারিনি।

পাহাড়ি চট্টগ্রাম, আরণ্যক চট্টগ্রাম শহর যখন ধুলা ময়লা, যানজট, জলজটের শহরে পরিণত হয়ে গেছে,  তখন সব হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। 

সিটি করপোরেশনে জীব বৈচিত্র্য জরিপের ফলাফলে শেষ পর্যন্ত কী পাওয়া গেল সেটি প্রকাশ্যে আর আসেনি। নাকি এই প্রকল্পও শেষ পর্যন্ত অন্যগুলোর মতো মাঝপথে স্তব্ধ হয়ে গেছে আমরা জানি না। চট্টগ্রামের পরিবেশবাদীরা, প্রকৃতিপ্রেমীরা এই জরিপের ফলাফল জানতে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি তাঁরা পাননি।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আরও একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। পাহাড় ধস এবং জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য পাহাড়ের গায়ে এখন বিন্না ঘাসের চাষ করতে চেয়েছিল সংস্থাটি। সিটি করপোরেশনের আশা ছিল এতে পাহাড়ের ক্ষয়রোধ কমবে এবং বৃষ্টির পানির সঙ্গে বালু ও মাটি এসে নালা নর্দমাও ভরাট হবে না। কারণ শনের পাতার মতো দেখতে এ ঘাসের শিকড় অনেক লম্বা হয়। চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে মাটির আট থেকে দশ ফুট গভীরে শিকড় চলে যায় এ ঘাসের। মাটির নিচে একটা শক্ত কাঠামো তৈরি করে এ ঘাস। প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। এই উদ্যোগের খবর পেয়ে মনে হলো বয়সকালে চুল হারিয়ে টেকো মাথায় চুল গজানোর অথবা কানের কাছে যে কয়টি চুল অবশিষ্ট থাকে সেগুলো টিকিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা। আমরা তো পাহাড় থাকতে পাহাড়ের মর্যাদা বুঝিনি।  তবে ঘাস রোপনের জন্য কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরের কর্তিত অর্ধ কর্তিত পাহাড়ের গায়ে বিন্না ঘাসের শোভা দেখা যায়নি।

চট্টগ্রাম শহর তো পাহাড়ের শহর, এখানকার বেশির ভাগ এলাকার নামের সঙ্গে পদবীর মতো জুড়ে আছে পাহাড় শব্দটি। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব আপনি খুঁজে পাবেন না। কোথাও সামান্য টিলার মতো দৃশ্যমান, বেশিরভাগ কর্তিত, খণ্ডিত, বিলীয়মান। কোথাও কোথাও দেখাই যায় না। দেব পাহাড়, চেরাগী পাহাড়, গোলপাহাড়, কাটাপাহাড়, রাজাপাহাড়, পরীর পাহাড়, দেওয়ান বাড়ি পাহাড়, গোদির পাহাড়, জিলিপি পাহাড়, টাইগার হিল, ডিসি হিল, মোলহিল, পার্সিভাল হিল এরকম কত এলাকার সঙ্গে পাহাড় বা হিল যুক্ত রয়েছে। সেসবের অধিকাংশই আজ শুধু ইতিহাস। পাহাড় কাটতে কাটতে এগুলোকে এমন ভঙ্গুর করে ফেলা হয়েছে। আজকাল হয়েছে বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসের আশঙ্কা হয়। গত দশ বছরে দুই শতাধিক মানুষের  যে প্রাণহানি হয়েছে চট্টগ্রাম শহরে। এরকম ট্র্যাজেডি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সিটি করপোরেশন আজ বিন্না ঘাসের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত  আমরা তার বাস্তবায়ন দেখলাম না।

আমরা পাহাড়ের গায়ে গায়ে বিন্নাঘাস দেখিনি। যাদের কাছে এসকেভেটর (খননযন্ত্র) আছে, হাতে শাবল, খুন্তি আছে, তাদের ঠেকাতে পারিনি। পাহাড়গ্রাসী সেইসব লোভাতুর দখলদারদের কবল থেকে সামান্য উদ্ভিদ বিন্নাঘাস কিই বা করতে পারে সেটাও প্রকল্প নেওয়ার সময় ভাববার অবকাশ পাইনি। বিন্নাঘাসের প্রাণ আছে, কিন্তু তাদের ঠেকানোর শক্তি তো তার নেই। কেননা বিন্নাঘাসের শেকড়ের মতো তাদের শেকড়ও বহু গভীরে প্রোথিত। এ সমাজে তাঁদের অবস্থান বড় মজবুত। এই জন্যই সচেতন মানুষ, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সংগঠন যতই উচ্চকণ্ঠ থাকুক না কেন, প্রতিদিন রাতের আঁধারে, প্রকাশ্য দিনের আলোয় নানাভাবে, নানা জায়গায় পাহাড় কাটা চলছেই। তাই সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সকল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আবেদন সবার আগে পাহাড়খাদক লোভী, পরিবেশের শত্রু, মানুষের, সভ্যতার সেইসব শত্রুর শেকড় উৎপাটন করার প্রকল্প হাতে নিন।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

উপরে