হিল্লোল বিশ্বাস
পাহাড়, নদী ও সমুদ্রঘেরা এক বৈচিত্র্যের নগর চট্টগ্রাম। তবে নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রভাবে চট্টগ্রামের পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনসংখ্যার চাপে আবাসন সমস্যা নিরসনে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের কারণে শিল্প কারখানা স্থাপনা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে বেশ পরিবর্তন হয়েছে চট্টগ্রামের পরিবেশ। তবে আশার কথা হচ্ছে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তর কঠোর। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা দায়ের করছে। আর বায়ু পানি শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর এনফোর্সমেন্ট, জরিমানা, মামলা এবং সচেতনতা কার্যক্রম চলমান রেখেছে। তবে ক্রমাগত দূষণের ফলে ধুলোবালি ও ধোঁয়া এবং পানি দূষণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী।
সার্বিক বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক হিল্লোল বিশ^াসের সঙ্গে কথা হয়। নিসর্গ নন্দন এর পক্ষে তাঁর সাথে কথা বলেন নয়ন চক্রবর্ত্তী।
চট্টগ্রাম ছিল প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এক শহর। এখন ইট-কংক্রিটে ভরা চারপাশ। এই শহরের উপর নগরায়নের প্রভাব কতটুকু পড়ছে?
নাগরিক সুবিধার বৃদ্ধির ফলে প্রথম ধাক্কা পড়ে প্রকৃতির উপরে। পানি বায়ু শব্দ দূষণ হয় নগরায়নের ফলে। তবে চট্টগ্রামে আমরা চেষ্টা করছি যাতে দূষণ কম হয়। শিল্পায়নের ফলে পরিবেশের যেসব ক্ষতি হচ্ছে তা আন্তর্জাতিকভাবেই চেষ্টা করছে পরিবেশ সুরক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে। বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টা করছে। সরকার শিল্পায়ন যেমন চায় তেমনি প্রাণ প্রকৃতি রক্ষাও চায়। চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ও এর বাইরে নয়। কেননা মানুষের জন্য সবকিছু। মানুষই যদি না থাকে তাহলে নগরায়ন শিল্পায়ন তো বৃথা। ৫০ লাখের উপর বাসিন্দা চট্টগ্রাম নগরীতে। এখনকার জলাধার যেগুলো ছিল তা রক্ষা করতে পারছি না। আবাসনের প্রয়োজনে, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে গিয়ে জলাধারগুলো বিলীন হয়েছে। পুকুর ভরাট করে বসতি স্থাপন হয়েছে। এসব রক্ষা করা খুব চ্যালেঞ্জিং। পরিবেশ অধিদপ্তর চেষ্টা করে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের যথাযথ প্রয়োগ করা। এনফোর্সমেন্ট, জেল-জরিমানা চলে। কিন্তু এসবের পরও মানুষ পরিবেশ দূষণ করে।
শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে মারাত্মক রূপ নিয়েছে বায়ু দূষণ। এ বিষয়ে আপনারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
ভারী শিল্প কলকারখানায় ধোঁয়া ও শব্দ দূষণ বেশি হয়। প্রতি তিন মাস পর পর পরিদর্শন করা হয়। ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এটিপি) করা হচ্ছে। আমরা তাদের চাপে রাখতে পরিদর্শন এবং মামলা করি। এটিপি স্থাপনের জন্য বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিচ্ছে। এটা ভালো দিক। বায়ু দূষণ রোধে কারখানাগুলো অনেক টাকা ব্যয়ে এসব স্থাপন করছে। জরিমানা করে যদি শিল্প বন্ধ করে দিই তাহলে এটি অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে। এসব শিল্পায়নের জন্য বাধা।
নগরীতে বায়ু দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে মাত্রা ২ থেকে ৮ গুণ বেশি দূষিত হচ্ছে বায়ু। নগরীতে বায়ুমান পরীক্ষা করা হলেও সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা করা হয় শিল্প এলাকায়। প্রতি বছরে দুইবার শিল্প এলাকার প্রতিটি কলকারখানায় আমরা এই পরীক্ষা করি।
পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা কেমন? এ নিয়ে সাধারণ মানুষের অবস্থান কী?
মানুষজন আগের অবস্থানে নেই। অনেক সচেতন। অনেক লোক পরিবেশ অধিদপ্তরে এসে অভিযোগ করছে পরিবেশ রক্ষায়। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের হটলাইনে কল করেও প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করছেন সাধারণ মানুষ। প্রধান কার্যালয় থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আমরা অভিযোগের প্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নিয়েছি। এভাবেই পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ রক্ষায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করছে। আমাদের কাছে যে সাধারণ মানুষ প্রতিকার চাইছে আমরা বিপরীতে অভিযুক্তদের নোটিশ দিয়ে এনে শুনানি পরিচালনা করছি। সাধ এবং সাধ্য সীমিত হলেও এগিয়ে চলছে পরিবেশ। শত সীমাবদ্ধতায় পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় কাজ চলছে।
পুকুর-দীঘি আর খাল ছিল বন্দর নগরীর প্রকৃতির অপরিহার্য অনুষঙ্গ। গত কয়েক দশকে বেশিরভাগ জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। জলাশয় ভরাট রোধ করা যাচ্ছে না কেন ?
চাইলে ভরাট করা যায় না। যদি কেউ ভরাট করে তাহলে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এমন কঠোরতায় অনেক পুকুর রক্ষা পেয়েছে। তবে এ বিষয়ে দাবিদারদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। একান্নবর্তী সম্পত্তিতে কয়েকজন ওয়ারিশদার পুকুরের কিছু অংশ ভরাট করে আবার অভিযোগ প্রদানকারী পক্ষ তখন বেকায়দায় পড়ে যায়। কিছু কিছু সম্ভব হলেও অংশীদারদের চাপে পাড় ভরাট করতে গিয়ে পুকুর ভরাট হয়ে যায়। নগরীর আগ্রাবাদ, ধনিয়ালা পাড়া, পানওয়ালা পাড়া, মোগলটুলি এলাকায় অনেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এসব পুকুর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অংশীদারী বিষয়।
শিল্প কারখানায় ইটিপি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বহু বছর আগে। বাস্তব চিত্র কী? পানি দূষণ কতটা ঠেকানো যাচ্ছে?
কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠানে ইটিপি আছে আবার অনেকের নেই। শিল্প প্রতিষ্ঠানে মাটিতে অনেক বর্জ্য মিশে যায়, এজন্য এসব কারখানা বর্জ্যকে মাটিতে না ফেলে এটিকে অন্যভাবে রিসোর্সমেন্ট করার চেষ্টা চলছে। এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে কিছু কেমিক্যাল জমা হয়। বিদেশে এসবের চাহিদা আছে। বিশেষ করে চীনে। এসব তারা কিনে নেয়। যা কেজি প্রতি ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। তার ওপর আবাসিক স্থাপনাগুলোতে আমরা পানির মান পরীক্ষা করি। আবাসিক ভবনগুলোর নকশায় আমরা আগে দেখি বৃষ্টির পানি মজুতে রিজার্ভারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি না।
পানি দূষণের বিষয়ে আমরা কারখানার পানির মান পরীক্ষা করি। আমাদের ল্যাব রিপোর্টে পানির মান খারাপ শনাক্ত হলে ছাড়পত্র দেয়া হয় না। পানির মান সঠিক হলেই বেকারি ও বিভিন্ন মিষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়।
শব্দ দূষণ বেড়েই চলেছে। এটা কমানোর উপায় কী?
শব্দ দূষণের জন্য মান নির্ধারণ করা রয়েছে। আবাসিক এলাকায় শব্দ দূষণের মান এবং শিল্প এলাকা ও মিক্সড এলাকায় ভিন্নতর রয়েছে। তবে চট্টগ্রামের জামালখান মোড় এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের এলাকাকে আমরা নিরব এলাকা ঘোষণা করেছি। আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবেল শব্দ নির্ধারণ করা আছে। চট্টগ্রাম শহরে বেশ কিছু এলাকায় এটি রক্ষা হয় না। চেষ্টা করছি। অযথা হর্ন ও মিছিল মিটিং এবং মাইক যাতে শব্দ দূষণ করতে না পারে এজন্য সচেতনতার জন্য প্রচারণার ব্যবস্থা করছি।
পাহাড় কাটা তো থেমে নেই, পরিবেশ অধিদপ্তরের অবস্থান কী?
পাহাড় কাটা নিয়ে চলে লুকোচুরি খেলা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পাহাড় কাটা বেশি হয়। শুক্র ও শনিবারে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা চলে। আমরা মামলা অভিযান পরিচালনা করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে কষ্ট হচ্ছে। সকালে অভিযান করে আসলে বিকালে আবার চলে পাহাড় কাটা। তবে চট্টগ্রামে রাতে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়।
সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করলে চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষা সম্ভব হবে। পাহাড় কাটবে কী কাটবে না, কোথায় কাটা হবে, কীভাবে রক্ষা করা হবে এসব নিয়ে পরিকল্পনা নেয়া উচিত। বায়েজিদ লিংক হতে আকবরশাহ এসব জায়গায় এনফোর্সমেন্ট করে পাহাড় রক্ষা সম্ভব নয়। চট্টগ্রামবাসী যতদিন সচেতন হবে না ততদিন নির্বিচারে পাহাড় নিধন চলবে।
কর্ণফুলী ও হালদা রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর কতটুকু আন্তরিক?
কর্ণফুলী ও হালদা মহানগর অংশে পানি দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহানগরের এই পরিচালক বলেন, তারা ইটিপি চালু না রাখায় নদী দূষণ হয়। এছাড়া অনেকে ইটিপি রাখেনি। তাদের জরিমানা করা হয়। যাতে ইটিপি নির্মাণ করা হয়।
উন্নয়নকাজের জন্য ব্যাপক দূষণ হচ্ছে, কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
‘অধিবাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে উন্নয়ন প্রয়োজন তবে পরিবেশ ধ্বংস করে নয়’ এমন বার্তা সকলের কাছে পৌঁছাতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সহযোগী সংস্থাগুলোই পরিবেশ রক্ষায় শর্ত দিয়ে কার্যাদেশ দেয়। এসবের ব্যত্যয়ে ঘটলে তারাই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখিও করে থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তর উন্নয়ন সহযোগী। উন্নয়ন প্রতিদ্বন্ধী নয়। চেষ্টা করি যেসব উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার। উন্নয়নকে যেমন বাধা দেয়া যাবে না তেমনি পরিবেশকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া যাবে না। পরিবেশ এখন বিশ^ সচেতনতার অংশ। এর থেকে পিছিয়ে থাকার চট্টগ্রামেরও সুযোগ নেই। উন্নয়নের সবক্ষেত্রে ছোঁয়া লেগেছে। সেইক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরও উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চায়।