আবুল মোমেন
চট্টগ্রাম এই অঞ্চলের প্রাচীনতম ধারাবাহিক নগরী। কলকাতার বয়স সাড়ে তিনশ বছরের মতো, ঢাকার বয়স চারশ’র চেয়ে কিছু বেশি। প্রাচীন বন্দর এবং কর্ণফুলির তীরে গড়ে ওঠা বিলুপ্ত নগরী হরিকেলের কথা বাদ দিলাম। কিন্তু বর্তমান নগরীর পত্তন হয়েছে সুলতানি আমলে। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ বঙ্গ-বিজয়ের অংশ হিসেবে সোনারগাঁ দখল করে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি আমলের সূত্রপাত করেন। ঐতিহাসিকদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সুলতানদের বাংলার সীমান্তবর্তী চট্টগ্রাম বিজয় করতে বেশি সময় লাগেনি, দু’বছর পরেই, ১৩৪০ সনে তাঁরা চট্টগ্রাম জয় করেন। তখন বন্দর ও জাহাজ চলাচলের সূত্রে চট্টগ্রাম নগরীর পত্তন হয়। সে হিসেবে এ নগরীর বয়স প্রায় এক হাজার বছর।
ধারাবাহিক নগরী হিসেবে সারাবিশ্বেই এত প্রাচীন নগরী কম আছে। আর পর্তুগিজ অভিযাত্রীদের পোর্টে গ্রান্দের উল্লেখ আরও পুরোনো। তবে আরব বণিকদের চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যোগাযোগ ৭ম শতাব্দী থেকে।
চীনা পর্যটক ইৎসিংও চট্টগ্রাম এসেছিলেন একই সময়ে। তিনিও এই সমৃদ্ধ বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন।
পাহাড়, নদী, সমুদ্র বেষ্টিত অরণ্যানী ঘেরা এ নগরীর দোসর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্রিটিশদের নজরে আসে এর অপরূপ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং বন্দর-কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা।
ফলে প্রথমে শিপিং কোম্পানি এবং শিপিং সংক্রান্ত অন্যান্য কোম্পানি, যেমন স্টিভেডরিং, বাল্ক কেরিয়ার, শিপ সার্ভে ও ইন্সপেকশন, ক্লিয়ারিং ফরোয়ার্ডিং ইত্যাদি গড়ে তোলে নিজেরা এবং স্থানীয়দেরও এসব ব্যবসায় সহায়তা দেয়। এরপর চট্টগ্রামকে হেডকোয়ার্টার করে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের বিস্তার ঘটায়। এসব সূত্রে নগরীতে ইংরেজ এবং বাঙালি শিক্ষিত মানুষের সমাগম বাড়তে থাকে। জনগণের নিত্য যাতায়াতের সুবিধার জন্যে হাটহাজারি, নাজিরহাট ও ধুম পর্যন্ত রেলের শাখা লাইন বিস্তৃত হয়। অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচলের ঘাট ও নৌ-বন্দরের তৎপরতা বাড়ে। এভাবে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে নানান পেশাজীবী, যেমন একদিকে ডাক্তার, উকিল, শিক্ষকের মতো শিক্ষিত শ্রেণি তেমনি অন্যদিকে সেবা খাতে মুচি, নাপিত, ধোপা প্রভৃতিও বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে স্কুল-কলেজ বেড়েছে, হাসপাতাল হয়েছে, ক্লাব, সমিতি গড়ে উঠেছে। তারপর নাগরিকদের সামষ্টিক সেবার জন্য মিউনিসিপ্যালটি, ওয়াটার ওয়ার্কস, ইলেট্রিক সাপ্লাই ইত্যাদি চালু হয়েছে। প্রয়োজনেই কন্ট্রাক্টর, ঠিকাদার, আড়তদারদের আবির্ভাব হয়েছে। বাজার, দোকানপাট, সিনেমা হল, পার্ক একে একে সংযুক্ত হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলেই এ নগরীতে শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে, তা অব্যাহত ছিল পাকিস্তান আমলেও। বাংলাদেশ আমলে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ এবং জনগণের আর্থসামাজিক মুক্তির প্রয়োজনে এই নগরীটি দেশের প্রধান শিল্প ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার ধারাটি অব্যাহত থাকা জরুরি ছিল।
কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দ্রুত বর্ধমান প্রত্যাশা ও প্রয়োজনের চাপ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকট, কেন্দ্রে ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের গুরুত্ব অনুযায়ী স্ব স্ব ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা, আশু প্রয়োজন ও তাৎক্ষণিক সুবিধার বিবেচনায় দূরবর্তী ও চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণে অপারগতা বা অনীহা মিলে বাংলাদেশও আজ উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত অনেক দেশের মতো এক-নগরীর রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। বলা বাহুল্য, সেই নগরীটি রাজধানী ঢাকা। অপর দিকে চট্টগ্রাম তার যথার্থ ভূমিকায় বিশিষ্ট অবস্থানের বিবেচনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকায় এখানেই সমুদ্রের ধারে দেশের প্রধান বন্দরের এবং রেলওয়ে নেটওয়ার্কের প্রধান কেন্দ্র অবস্থিত হলেও নৌবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকল সদর দপ্তর রাজধানীতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এর সাথে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর, সম্পূর্ণ রাজস্ব বোর্ড, শিল্প, কর, আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট সকল সদর দপ্তর এবং সরকারি-বেসরকারি সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর রাজধানীতে অবস্থিত হওয়ায় একদিকে চট্টগ্রাম-ঢাকা টানাপোড়েন আর অন্যদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘসূত্রতা স্থানীয় উদ্যোক্তা সমাজকে প্রথমে হতোদ্যম করেছে ও শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনেই ঢাকামুখী হতে বাধ্য করেছে। চট্টগ্রাম থেকে বিগত তিন দশকে বহু দেশি-বিদেশি শিল্পকারখানা, অন্তত এগুলোর সদর দপ্তর, ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে। স্বভাবতই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নগরের সুষম বিকাশে এবং নগরজীবনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও। ফলে উন্নয়নের মধ্যেও চট্টগ্রামের বাহ্যরূপে অনাদর ও অবহেলার ছাপই ফুটে উঠেছে Ñ রাজধানী ঢাকার সাথে এর ফারাক এখন বিস্তর।
তবে চট্টগ্রামকে ঘিরে আঞ্চলিক আর্থরাজনৈতিক রূপান্তÍরের যে সংযোগ তৈরি হয়েছে এবং তাকে কাজে লাগানোর জন্যে বর্তমান সরকারের আগ্রহ ও আন্তরিকতা চট্টগ্রামের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে। ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট, গভীর সমুদ্র বন্দর, এশিয়ান হাইওয়েসহ চীনের গুয়াংজু প্রদেশ পর্যন্ত সংযোগ, বঙ্গোপসাগরের অধিকার প্রাপ্তি ও ব্লু ইকনমির সম্ভাবনা এই ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছে। আলোচ্য সুযোগগুলো কাজে লাগানো সম্ভব হলে চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণ উপস্থিত হবে। আমরা জানি এ অঞ্চলের উদ্যোক্তাগণ এ সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে ওয়াকেবহাল এবং গভীরভাবেই এসব খতিয়ে দেখছেন। আজকের দিনে যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে একদিকে স্থানিক দূরত্বের বাধা অনেকটাই কাটানো সম্ভব আর অন্যদিকে ঘরে বসে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক যোগাযোগ তৈরি ও রক্ষা করা সহজ হয়েছে। ফলে এবারে চট্টগ্রামের হৃত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ফিরে পাওয়ার আর স্থবিরতা ও অবক্ষয় কাটিয়ে এগিয়ে চলার দিন সমাগত। শুধু প্রয়োজন ক্ষুদ্র স্বার্থ ও মতভেদ ভুলে সবাই মিলে মুক্তমনে চট্টগ্রামের স্বার্থে একযোগে কাজ করা।
আমরা মনে করি, এই ক্রান্তিকালে গণমাধ্যম উদ্যোগী নাগরিকদের মধ্যে ক্যাটালিস্টের ভুমিকা পালন করতে পারে। পরিবর্তনের জন্য সাধারণ নাগরিকদের প্রস্তুত করতে পারে এবং তাঁদের সম্ভাব্য বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ও ভূমিকা পালনের সুযোগ সম্পর্কেও অবহিত ও উদ্বুদ্ধ করতে পারে। চট্টগ্রামের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের উদ্যোগগুলো এই নগরীর প্রয়োজনে উত্তরণের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়কে ফলপ্রসূ করে তোলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আশা করি সচেতন নাগরিক সমাজ আজকের মেধাবী তরুণ সম্প্রদায়কে নিয়ে এই যুগান্তরের জন্যে আগামীতে এক সাথে কাজ করে যাবেন। এ কাজ বিরামহীনভাবেই এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক